নতুন প্রজন্মের মূল্যায়ন

কুমারস্বামীর একশো বছর আগে প্রকাশিত বইয়ের আলোচনা করতে গিয়ে মলি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে মুঘল চিত্রকলার জগৎও ওই একই বিচারে আর এক জাদুর জগৎ, তবে ভিন্নধর্মী। আর তখন কুমারস্বামীর অজানা আরও এক দিগন্তের সন্ধান দিয়েছেন— দাক্ষিণাত্যের চিত্রকলা বা ডেকান পেন্টিং।

Advertisement

অশোককুমার দাস

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৭ ০০:২৪
Share:

বীরাঙ্গনা: ঈগল নিয়ে শিকারে চাঁদ বিবি। আনুমানিক ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে খান্দেশ-এ অঙ্কিত। ব্রিটিশ লাইব্রেরি সংগ্রহ। ছবি: বই থেকে

আ ম্যাজিক ওয়ার্লড/ নিউ ভিশন্‌স অব ইন্ডিয়ান পেন্টিং

Advertisement

সম্পাদক: মলি এমা আইটকেন

মূল্য: ২৮০০.০০

Advertisement

প্রকাশক: মার্গ ফাউন্ডেশন

আনন্দ কেন্টিশ কুমারস্বামীর ১৯১৬ সালে দু’খণ্ডে প্রকাশিত রাজপুত পেন্টিং ভারতীয় শিল্প-ইতিহাস রচনায় নিঃসন্দেহে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। তখনকার ঔপনিবেশিক ভাবধারা, পাশ্চাত্য শিল্পের গুণগানের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের উন্মেষকালে কুমারস্বামী এই প্রকাশনার মাধ্যমে সোচ্চারে ঘোষণা করেছিলেন যে ভারতীয় উপমহাদেশে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুগ যুগ ধরে স্থাপত্য ভাস্কর্য ললিতকলা ও কারুশিল্পের বিস্ময়কর ক্রমবিকাশকে কোনও ভাবে পাশ্চাত্য শিল্পের সঙ্গে তুলনা করে নিরেশ বলে প্রতিপন্ন করা যায় না। তাঁর মুখ্য প্রতিপাদ্য ছিল রাজস্থান ও পাহাড়ি অঞ্চলে নির্মিত ছবি ও রেখাচিত্রে বলিষ্ঠ ও নমনীয় রেখার কাজ, উজ্জ্বল বর্ণসমাবেশ, অন্তর্নিহিত ভাবাবেগ ও দার্শনিকতা যে জগতের আভাস দেয় তা এক জাদুর জগৎ।

তারপর একশো বছর কেটে গিয়েছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন শৈলীতে আঁকা চিত্রাবলি, চিত্রিত পুথিপুস্তক, দেওয়ালচিত্র ও রেখাচিত্রের আবিষ্কার হয়েছে, ভারতীয় শিল্পের সংজ্ঞা বদলে গিয়েছে, চিত্রায়িত জগতের প্রসার ঘটেছে, বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্যের যে রকম প্রকাশ তার পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন হয়েছে। মুলকরাজ আনন্দ প্রতিষ্ঠিত মুম্বইয়ের মার্গ ফাউন্ডেশন (আগেকার মার্গ পাবলিকেশন) সে কাজের ভার দিয়েছেন নতুন প্রজন্মের এক তাত্ত্বিক শিল্প-ইতিহাসবিদ মলি এমা এইটকেন-এর উপর। মলি সঙ্গে নিয়েছেন এই প্রজন্মের আটজন ব্যাখ্যাতা ও শিল্প-ইতিহাসবিদকে। সংযোগবশত তাঁরা সকলেই মহিলা, একজন বাদে সকলেই আমেরিকার (ও কানাডার) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সংগ্রহশালায় কর্মরত। আলোচ্য সুপরিকল্পিত দৃষ্টিনন্দন বইটি এই উদ্যোগেরই ফল।

কুমারস্বামীর একশো বছর আগে প্রকাশিত বইয়ের আলোচনা করতে গিয়ে মলি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে মুঘল চিত্রকলার জগৎও ওই একই বিচারে আর এক জাদুর জগৎ, তবে ভিন্নধর্মী। আর তখন কুমারস্বামীর অজানা আরও এক দিগন্তের সন্ধান দিয়েছেন— দাক্ষিণাত্যের চিত্রকলা বা ডেকান পেন্টিং।

এই আটজন লেখক তাঁদের অধ্যাপনা বা সংগ্রহশালার দায়িত্ব সামলেও যে রকম নতুন বিষয়ে চিন্তা করেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ম সান ফ্রান্‌সিস্কোর কিউরেটর কমর আদমজি ‘চান্দায়ন’ (বা ‘লোরচন্দা’) নিয়ে প্রাক্‌মুঘল শৈলীতে চিত্রিত যে পাঁচটি সম্পূর্ণ বা খণ্ডিত পুথি আবিষ্কৃত হয়েছে তার আলোচনা করেছেন। আমহার্স্ট কলেজ ম্যাসাচুসেট্‌স-এর শিক্ষিকা ইয়ায়েল রাইস-এর প্রবন্ধের বিষয়বস্তু আকবরের তসবিরখানার প্রাথমিক পর্বে জ্যোতিষ, রাশিশাস্ত্র ও জাদুবিদ্যার উপর আঁকা খণ্ডিত পুথি ‘শির-অল-মখতুম’। নিউইয়র্ক মেট্রোপলিটান মিউজিয়মের কিউরেটর নবীনা নজত হায়দর তাঁর প্রবন্ধ লিখেছেন বিজাপুর ও গোলকোন্ডায় নির্মিত একগুচ্ছ ছবি নিয়ে যেখানে কাল্পনিক পুষ্পসম্ভার প্রজাপতি ও কীটপতঙ্গ এক ধরনের হেঁয়ালি ভরা জগতের হদিশ দেয়। কলেজ অব নিউ জার্সির শিক্ষক ডেবোরা হাটন লিখেছেন বিজাপুরের বীরাঙ্গনা চাঁদবিবিকে নিয়ে যাঁর অগণিত কাল্পনিক প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে মৃত্যুর এক-দু’দশক পরে।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিতা সিংহের লেখার বিষয় বস্টন মিউজিয়ামে কুমারস্বামীর সংগ্রহ করা দরবারি শিল্পী চিত্ররমনের আঁকা সম্রাট মুহম্মদ শাহের হারেমের অভ্যন্তরে রতিক্রীড়ার ছবি। ফ্রিয়ার-স্যাকলার গ্যালারির কিউরেটর ডেব্‌রা ডায়মন্ড বেছে নিয়েছেন মুঘল ও রাজস্থানি দরবারে উদ্‌যাপিত হোলির বর্ণময় একগুচ্ছ ছবি। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপ্তি খেরা কুমারস্বামীর ভাবধারার অনুসরণে লিখেছেন কী ভাবে মেবারের দরবারি ছবিতে সাহিত্য সংগীত সামাজিক অনুষ্ঠান ও বিনোদনের মেলবন্ধন হয়েছিল। কানাডার রয়্যাল অন্টারিয়ো মিউজিয়মের কিউরেটর দীপালি দেওয়ান মেবার ও নাথদোয়ারায় সাবেকি চিত্রশিল্পের রেওয়াজ যে ঔপনিবেশিক যুগে নতুন আসা আলোকচিত্রের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

সব মিলিয়ে পড়ার মতো, ভাববার মতো ও সংগ্রহযোগ্য একটি প্রকাশন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন