শিল্পিত: চার অধ্যায় নাটকের অভিনয়ে শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র।
পাঁচটি ভাগে মোট সতেরোটি লেখা নিয়ে এই সঙ্কলন। অধিকাংশ প্রবন্ধ কোনও না কোনও উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে লেখা। এর মধ্যে শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্মদিন থেকে জন্মের শতবর্ষ, সার্ধশতবর্ষ, বইয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে লিখিত প্রবন্ধ আছে। পাশাপাশি স্মারক বক্তৃতা, স্মরণলেখও জায়গা করে নিয়েছে। উদ্যাপনের মধ্যে এক রকমের আনুষ্ঠানিকতা থাকে, এই প্রবন্ধগুলি সেই গোত্রের নয়। রুশতী সেন উদ্যাপনের মধ্যে যাপনকে খুঁজেছেন, যা এক জন শিল্পী-সাহিত্যিককে শুধু বুঝতে সাহায্য করে না, কঠিন সময়ে আমাদের অবস্থান ঠিক করতে সাহায্যও করে।
প্রথম প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে মৃত্যুদিন কেন্দ্র করে। বহুচর্চিত রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনার পরিবর্তে এখানে আলোচিত ১৯৪১ সালের ৬ মার্চ লেখা ‘ধ্বংস’ গল্পটি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষিতে ফরাসি দু’টি চরিত্র, বাবা পিয়ের শোপ্যাঁ ও মেয়ে ক্যামিলকে নিয়ে এই গল্প। বাবা ও মেয়ের একান্ত ভালবাসার বিষয় হল তাদের ফুলের বাগান। জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় সরকারের চাপে পিয়েরকে রণাঙ্গনে যেতে হল। মেয়ে কথা দিল বাগান বাঁচিয়ে রাখবে। বাবা এক সময় সেনানায়কের পদ পেল, কিন্তু যুদ্ধের গোলা উড়ে এসে বাগান ধ্বংস করে দিল, মারা গেল ক্যামিলও। যে রবীন্দ্রনাথের পশ্চিমি যুক্তি, প্রগতি ও আধুনিকতায় এক সময় বিশ্বাস ছিল, তিনিই জীবনের শেষ সময়ে ‘ধ্বংস’ ও ‘সভ্যতার সঙ্কট’ লিখছেন। তাঁর এই বিশ্ববোধের উত্তরাধিকার কি আমরা পেয়েছি? ভয়, সংশয় ও ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির উৎকট হিসাব-নিকাশ প্রত্যাখ্যান করে রবীন্দ্রনাথের জীবন, মনন ও সৃষ্টির মধ্যে থেকে নিত্যদিনের কোনও পাথেয় সংগ্রহ করতে পেরেছি? প্রশ্ন প্রাবন্ধিকের।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আরও পাঁচটি প্রবন্ধ বইটিতে। প্রথমটি গল্পসপ্তক নিয়ে, যা ইন্ডিয়ান প্রেস থেকে ১৩২৩-এর শরতে প্রকাশিত হয়। গল্পগুলি: ‘হালদারগোষ্ঠী’, ‘হৈমন্তী’, ‘বোষ্টমী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘ভাইফোঁটা’, ‘শেষের রাত্রি’ ও ‘অপরিচিতা’। সব ক’টি গল্পই ১৩২১-এ প্রমথ চৌধুরীর সবুজ পত্র পত্রিকায় বৈশাখ থেকে কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। রুশতী বইটির আলোচনায় দেখিয়েছেন, পুরো গল্পগুচ্ছ বইটির একটা আদল সে সময়ে অবিক্রীত ও অপঠিত গল্পসপ্তক-এ ছিল। এও বলেছেন, একুশ শতকের প্রেম-অপ্রেম, লোভ-চাহিদা এবং পাওয়া না-পাওয়ার জটিলতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ে দাঁড়িয়ে যেন অনেকখানি দেখতে পেয়েছিলেন। চার অধ্যায় নিয়ে প্রবন্ধটি ১৯৩৪-এ প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস এবং ১৯৫১-য় শম্ভু মিত্র নির্দেশিত ও ‘বহুরূপী’ প্রযোজিত উপন্যাসটির মঞ্চায়ন কেন্দ্র করে। সতেরো বছরের সময় দূরত্বে পরাধীন দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু উপন্যাসের মূল প্রশ্নটি তখনও সত্য হয়ে থেমে গেছে। চল্লিশের দশকের শেষের রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও তার পরিণতির কথা বিচার করলে বোঝা যাবে, যারা প্রদীপ জ্বালাতে এসেছিল তারা আগুন জ্বালিয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮১-তে চার অধ্যায় মঞ্চায়নের তিন দশক পূর্তিতে ‘চেনামুখ’-এর প্রযোজনায় শম্ভু ও তৃপ্তি মিত্র যখন অভিনয় করছেন, তার পিছনে সত্তর দশকের দিশাহীন আগুনের প্রবল উত্তাপ ও উন্মাদনা তখনও প্রশমিত হয়নি।
যাপন-উদ্যাপন
রুশতী সেন
৪০০.০০
প্যাপিরাস
পরের তিনটি প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় সঙ্গীত। প্রথমটি সত্যজিৎ রায়ের নির্বাচিত চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার। দ্বিতীয়টি অরুন্ধতী দেবীকে নিয়ে, এখানেও অনেকটা জুড়েই রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা। তৃতীয়টি সুচিত্রা মিত্রের গানে মনের বৈভবের কথা, আর সে গান যে রবীন্দ্রসঙ্গীত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সত্যজিৎ প্রসঙ্গে আলোচনায় রুশতী সঙ্গীতের ভাষায় আলোচনা করে দেখিয়েছেন কেমন ভাবে তাঁর চলচ্চিত্রে সংলাপ, সংলাপহীনতা, আলো ও অন্ধকারের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত সঙ্গত করেছে। কোথাও আবার সে সঙ্গীতের সামান্য ব্যবহার সারা চলচ্চিত্র জুড়ে রেশ রেখে গেছে। অরুন্ধতী দেবী ছ’বছর বয়েসে ডাকঘর-এর অমলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, বারো বছর বয়সে ছাতিমতলায় রবীন্দ্রনাথের কাছে গানের পরীক্ষা দিয়ে সঙ্গীতভবনে প্রবেশ করেছিলেন, ইন্দিরা দেবীর কাছে গানের তালিম নিয়েছিলেন আর মায়ার খেলা-য় কণিকা যখন প্রমদা, অরুন্ধতী তখন শান্তার চরিত্রে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। রুশতী তাঁর প্রবন্ধে অরুন্ধতী দেবীর চলচ্চিত্রে গাওয়া গান, অভিনয় ও পরিচালনার কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। সুচিত্রা মিত্রকে নিয়ে লেখাটিতে উল্লেখ করেছেন বিষ্ণু দের ‘সুচিত্রা মিত্রের গান শুনে’ কবিতার দু’টি স্মৃতিধার্য পঙ্ক্তি, “সামগ্রিক ঐশ্বর্যের যুক্ত সপ্ত স্বরে/ মানবিক উত্তরণে মনের বৈভব।” বেশ কয়েকটি গানের আলোচনার মধ্যে দিয়ে রুশতী দেখিয়েছেন সুচিত্রার ঋজু ব্যক্তিত্ব, সঙ্গীতের প্রতি দায়বদ্ধতা, গায়নের সংবেদন, গায়নকালীন শরীরী ভাষা ইত্যাদি তাঁকে স্বতন্ত্র করে তোলে।
পরের আলোচনার বিষয় শিশু ও কিশোর সাহিত্য। এর মধ্যে দু’টি লেখা অবনীন্দ্রনাথ, একটি গৌরী ধর্মপাল আর দু’টি লীলা মজুমদারকে নিয়ে। প্রথম লেখাটির বিষয় ১৮৯৬-এ প্রকাশিত ক্ষীরের পুতুল। এমন এক রূপকথা যেখানে ‘সবই স্বপ্ন অথচ তার চেয়ে বেশি সত্যি আর নেই’। আর এর প্রধান কারণ, সে রূপকথার কথক হচ্ছেন নর্মাল স্কুলের এক সময়ের বেত-খাওয়া, নাম-কাটা ছাত্র ‘ওবিন ঠাকুর— ছবি লেখে’। অবন ঠাকুর ঠাকুরবাড়ির ছোটদের পাশাপাশি বাংলার লক্ষ লক্ষ শিশুকে চাঁদের শোভা দেখতে শিখিয়েছিলেন। সে কথা রয়েছে ‘ওবিন ঠাকুরের চাঁদমামা’ লেখাটিতে। ‘চাঁদনি’ নামের রূপকথা, স্মৃতিভ্রষ্ট দুষ্মন্তের স্মৃতি ফেরাতে শকুন্তলার পূর্ণিমা রাতের বিবরণ, ভূতপত্রীর মাঠের মাথার উপরে চরকা ঘোরানো মামা আর চরকাকাটা বুড়ি মামি, নালক-এ বুদ্ধদেবের জন্মের সময়ে শালগাছের উপরে সোনার ছাতার মতো চাঁদের কথা ভোলার নয়। অবনীন্দ্রনাথ বাঙালি শিশুদের আলোময় একটা পুরো আকাশ দিয়েছিলেন। পরের লেখা গৌরী ধর্মপালকে নিয়ে, যাঁর ‘আশ্চর্য কৌটো’, ‘কালোমানিক’, ‘চোদ্দপিদিম’, ‘নৈনির বই’, ‘গৌরের ঝাঁপি’ ইত্যাদি লেখায় কীটপতঙ্গ ও মানবশিশুর জগৎ মিলেমিশে গেছে। লীলা মজুমদারের আলোচনায় এসেছে ভীম ও বকরাক্ষসের যুদ্ধ দেখতে দেখতে হিড়িম্বার প্রশ্ন, “হ্যাঁগা, মাঝখানে একবার টিপিনের ছুটি হবে না?”
লীলা মজুমদারের উপর আরও দু’টি প্রবন্ধ আছে, যার প্রথমটিতে ছোটদের জন্যে লেখা গল্পে বড়দের প্রাপ্তির কথা। যেমন নাবালকদের মন-মাতানো গল্প শোনানোর আড়ালে সাবালকদের বলেছেন, তোমার সন্ততি যেন বাঁচতে পারে ‘নেই’ হওয়া সফলতার নেশা থেকে। পরের আলোচনায় ‘শ্রীমতী’, ‘জোনাকি’, ‘মণিকুন্তলা’, ‘চীনে লণ্ঠন’ ইত্যাদি উপন্যাসের কথা এসেছে। সেখানে আধুনিক নারীবাদ নেই, কিন্তু খাঁচার বাইরে নারীদের দিনান্তে এক বার ওড়ার স্বপ্ন আছে। পরের লেখা ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে নিয়ে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন ইন্দিরা। তিনি যে ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়েদের থেকে শুরু করে কাজের মেয়ে খোদনের মায়ের সমস্যা নিয়ে বলেছিলেন, তা আর কে কতটুকু মনে রেখেছে? অথচ নারীদের আত্মনির্ভরতার বিবর্তিত সামাজিক পাঠে তা বেশ জরুরি।
বইটির শেষ অংশে চারটি লেখা, প্রথমটি সুকুমার রায়কে নিয়ে। তাঁর ছড়া বইয়ের পাতার ভিতর আটকে না থেকে কী ভাবে খাওয়ার জায়গা, কলেজের মাঠে ঘুরে বেড়াত তার উল্লেখ; সুকুমারের ছোটবেলার দুষ্টুমি থেকে কালাজ্বরে ভোগান্তি ও চিকিৎসা কেমন ভাবে তাঁর ছড়ায় জায়গা করে নিয়েছে, সে আলোচনাও। পরের লেখায় বিভূতিভূষণের আম আঁটির ভেঁপু, লীলা মজুমদারের টং লিং ও শঙ্খ ঘোষের সকালবেলার আলো বই তিনটির আলোচনা আছে। রুশতী দেখিয়েছেন, সময়ের বিবর্তনে শিশু-কিশোরদের জগৎ অনেকখানি আলাদা হয়ে গেছে। ‘কোন দেশেতে টান’ প্রবন্ধে ‘দেশান্তর’ কবিতাটির সূত্র ধরে শঙ্খ ঘোষের সুপুরিবনের সারি এবং বড়ো হওয়া খুব ভুল বই দু’টি নিয়ে আলোচনা করেছেন, দেশভাগের বিষাদ তুলে ধরেছেন। শেষ লেখা শঙ্খ ঘোষের সামান্য অসামান্য, নির্মাণ ও সৃষ্টি এবং কুন্তক ছদ্মনামে লেখা শব্দ নিয়ে খেলা বই তিনটি নিয়ে। সেখানে লিখেছেন, শঙ্খ ঘোষের লেখায় যুক্তি ও আবেগ পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠে, পাঠককে সহজেই কাছে টানে।
বইটির বিশেষত্ব তাঁর পাঠের নিবিড়তা, যুক্তির শৃঙ্খলা, সমালোচনার স্বাদু গদ্য। কোনও লেখা বা লেখক নিয়ে তাঁর শেষ কথা বলার তাগিদ বা তাড়া নেই, ভাল লাগে সেটাও।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে