উদার মন বারে বারে উঁকি দেয়

‘‘কেন এ ভাবে সপরিবার খুন হতে হল বঙ্গবন্ধুকে? শুধুই ষড়যন্ত্র? তৎক্ষণাৎ জনস্রোত তো আছড়ে পড়ে নিকেশ করে দিল না ঘাতকদের? ক্ষমতার চার বছর কি শেখ মুজিবকে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল?’’

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share:

বঙ্গবন্ধু: জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার শেখ মুজিবুর রহমান।

ধানমন্ডি রোডের ৩২ নম্বর বাড়ির দেখভালের দায়িত্বে থাকা আপা (দিদি) বলে চলেছেন—

Advertisement

... তার পরে ঘাতক সেনারা যখন সিঁড়ির মুখে পৌঁছে গেল, দোতলার ঘর থেকে সটান নেমে এলেন বঙ্গবন্ধু। দাবড়ে বললেন, “তোরা কী চাস? কেন এসেছিস এখানে? এখনই ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যা।”

ঘাতকেরা থতমত খেয়ে বন্দুক নামিয়ে নিল। সামনে যে খোদ বঙ্গবন্ধু! নির্দেশ দিয়ে সিঁড়ি ধরে ফের দ্রুত পায়ে উঠে আসছিলেন শেখ মুজিব। সেই সময়ে নির্দেশ অমান্য করে এক ঘাতক উঠে এল দু’পা। পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে সিঁড়ির বাঁকে ঘুরে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু। আর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে লুটিয়ে পড়লেন। এ বার ঘাতকেরা উঠে এসে তাঁর দেহের ছবি তুলল। রাষ্ট্রপতিকে হত্যার প্রমাণ হিসাবে সে ছবি পশ্চিমি সংবাদ মাধ্যমে পাঠানোর ব্যবস্থা হল। ইতিমধ্যে কয়েক জন দোতলায় উঠে এসে বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরে ঢুকে পড়ল। শেখ মুজিবের গোটা পরিবারকে নিকেশ করাই উদ্দেশ্য ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের।

Advertisement

ঘাতকের তোলা বঙ্গবন্ধুর সেই ছবির বড়সড় একটি প্রিন্ট এখন সেই সিঁড়ির মুখেই টাঙানো। দোতলা জুড়ে আগলে রাখা অগোছাল বুলেটের চিহ্ন, ছোপ ছোপ রক্ত, ছিটকে সিলিংয়ে আটকে থাকা চুল সমেত শিশুর করোটির অংশ যখন দর্শনার্থীদের হৃদয়ে পাথর রেখে অনায়াসে বাকরুদ্ধ করে ফেলেছে, সেই সময়েই এক বিদেশি সাংবাদিকের বেয়াড়া প্রশ্ন—

‘‘কেন এ ভাবে সপরিবার খুন হতে হল বঙ্গবন্ধুকে? শুধুই ষড়যন্ত্র? তৎক্ষণাৎ জনস্রোত তো আছড়ে পড়ে নিকেশ করে দিল না ঘাতকদের? ক্ষমতার চার বছর কি শেখ মুজিবকে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল?’’

শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী ছিল এক অসামান্য রাজনৈতিক দলিল। স্বাধীন পাকিস্তানের জন্য ব্রিটিশের বিরুদ্ধে মুসলমান বাঙালির প্রাণপণ জেদের যে বাস্তবতা, সেই না-বলা আখ্যান উঠে এসেছিল হোসেন সুরাবর্দির অনুসারী শেখ মুজিবের কথকতায়। পরে পশ্চিম পাকিস্তানের পঞ্জাবি শাসকদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের লড়াই চালানোর জন্য আওয়ামি লিগ গঠনে এসে থমকে গিয়েছিল মুজিবের বইটি। কারণ তত দিনে বাংলার গণমানুষের অগাধ আস্থা অর্জন করে বঙ্গবন্ধুতে উন্নীত হতে চলা মুজিবকে কারাবন্দি করে ফেলেছে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা। সুতরাং বিদেশি সাংবাদিকের সেই অমোঘ প্রশ্নটির জবাব পাওয়ার সুযোগ সে বইটিতে ছিল না।

পাকিস্তান আমলে দফায় দফায় বন্দিদশার দিনলিপির সংকলন শেখ মুজিবের দ্বিতীয় গ্রন্থ কারাগারের রোজনামচা। সে অর্থে আত্মজীবনীও তো দিনলিপিই। তবে কারাগারে একক বন্দিত্বে বেঁধে রাখা এক মানুষের এই দিনপঞ্জিও এক অনন্য নথি। কেন তিনি মহান নেতা, কী ভাবে মানুষকে পড়ে ফেলেন অবলীলায়, প্রভাবিত করতে পারেন তাঁকে— তেমন নানা ঘটনার সমাহার এখানে। লুদু চোর থেকে পুষে-পেলে বড় করা মুরগি ক’টা— কেউই তাঁর স্নেহচ্ছায়া থেকে বঞ্চিত হয় না। হাজতি বা কয়েদি, কেউ যদি ম্যাট্রিক বা অন্য পরীক্ষায় বসতে চায়— তার জন্য উপরোধে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। পরীক্ষার দিন নিজের ভাগের ডাব পাঠিয়ে দেন। জেলে আসা দলের কর্মীদের জন্যও কী ব্যাকুলতা এই নেতার! কেউ একমাত্র রোজগেরে, কী ভাবে সংসার চলবে তাঁর? কেমন আছে অসুস্থ ছাত্রকর্মীটি? নির্যাতনে ন্যুব্জ কোনও কর্মী হতাশ হয়ে দুটো কথা বললে, তাঁর পিঠে হাত দিয়ে বলছেন, ‘‘দেখো, তোমাদের এই ত্যাগ কখনও বিফলে যাবে না!’’

পাগল ওয়ার্ডের গায়ের সেলটিতে রাখা হয়েছিল শেখ মুজিবকে। ইদের দিনে বাড়ির পাঠানো খাবার অন্য বন্দিদের বিলিয়ে দিয়ে মনে পড়ল তাঁর— পাগল ভাইদের তো কিছু দেওয়া হল না! পরের দিন মুরগি আনিয়ে নিজে রান্না করে পাঠালেন জনা সত্তর পাগল বন্দির জন্য।

রোজনামচার পাতায় ধর্মীয় গোঁড়ামি মুক্ত এক উদার মন বারে বারে উঁকি দেয়। মুজিব লিখছেন, ‘‘দুপুর বেলা দেখা এক মওলানা সাহেবের সঙ্গে, কোরানে হাফেজ, তাঁর বাবাও খুব বড় পীর ছিলেন, কুমিল্লায় বাড়ি। হাজতিদের মধ্যে নামাজ পড়বার আগে বক্তৃতা করছেন, ওয়াজ করছেন, হাজতিরা বসে শুনছে।... চমত্কার বলার কায়দা। তবে তার জামাটা খুব বড়। ঐটা দেখে মনে সন্দেহ হল।

কারাগারের রোজনামচা

শেখ মুজিবুর রহমান

৪০০.০০, বাংলা একাডেমি (ঢাকা)

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই মওলানা সাহেব কী মামলায় এসেছেন।’ আমাকে এক ‘পাহারা’ বলল, ‘জানেন না, রেপ কেস।’ একটা ছাত্রীকে পড়াইত, তার উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, মসজিদের ভিতর।... আমি বললাম, ‘হাজতে এসে ধর্ম প্রচার শুরু করেছে।’ বেটা তো খুব ভণ্ড।... আলাপ হলে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এমন কাজটা করলেন ছাত্রীর সাথে, তাও আল্লাহর ঘর মসজিদের ভিতর।’ তিনি বললেন, ‘মিথ্যা মামলা, এ কাজ আমি কোনো দিন করতে পারি!’ তবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বেশি কথা বলে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন আমার কাছে।’’

১৯৬৬ সালের ১৩ জুলাই দিনলিপির পাতায় তাঁর উচ্চারণ— ‘‘ভারতের উচিত ছিল গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে নিয়ে দুই দেশের (ভারত-পাকিস্তানের) মধ্যে একটা স্থায়ী শান্তি চুক্তি করে নেওয়া।... ভারত যখন গণতন্ত্রের পূজারি বলে নিজেকে মনে করে তখন কাশ্মীরের জনগণের মতামত নিতে কেন আপত্তি করছে? এতে একদিন দুইটি দেশই এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হতে বাধ্য হবে।’’

আমেরিকার তত্কালীন আগ্রাসী বিদেশনীতির বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের কষাঘাত বারে বারে ফুটে উঠেছে দিনলিপির পাতায়। মুখে সাম্যবাদের কথা বলে অন্য দেশের স্বৈরাচারীদের সঙ্গে আপসের কারণে বিঁধেছেন চিনকেও। অর্থের জন্য তাদের কাছে হাত পাততে হওয়ায় মনোকষ্টের কথাও বলেছেন। তা হলে বিদেশনীতির কী পথ ঠিক মনে করেছেন মুজিব?

১৯৬৬-র ১৮ জুন লিখছেন, ‘‘ভিক্ষুকের কোনও মর্যাদা নেই। একমাত্র সমাজতন্ত্র কায়েম করলে কারও কাছে এত হেয় হয়ে সাহায্য নিতে হত না। দেশের জনগণেরও উপকার হত।’’ সোভিয়েতের হাত ধরায় যে জনগণের উপকার হবে, কয়েক বারই সে কথা বলেছেন তিনি।

ইতিহাস বলছে, পরে অবশ্য রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে তিনি আর সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ধাঁচে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামি লিগ’ (বাকশাল) গঠন করেন। রোজনামচায় ‘প্রেস ফ্রিডম’ নিয়ে অনেক কথা বললেও, ‘বাকশালি সমাজতন্ত্রে’ সরকারি সংবাদপত্র ছাড়া বাকি সব বন্ধ করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি ভেবেছিলেন, এতে জনগণের উপকারই হবে। কিন্তু বাকশালের বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সত্যিই বন্ধুত্বে ছেদ পড়েছিল মানুষের। সেই সুযোগই নিয়েছিল চক্রান্তকারীরা।

বইটির ভূমিকায় মুজিব-কন্যা শেখ হাসিনার লেখাটিও এক অসামান্য নথি। তাঁর মা বেগম ফজিলাতুননেছা রক্তাক্ত দিনগুলিতেও এই রোজনামচাকে কী ভাবে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, কার্যত বিধ্বস্ত ৩২ নম্বর ধানমন্ডি রোডের সেই বাড়ি থেকে কী ভাবে কৌশলে শেখ হাসিনা বাবার এই দিনলিপির খাতা উদ্ধার করে এনেছিলেন, সেও তো এক ইতিহাসই।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন