book review

কী করে বাঁচবে লোকে...

আর্থনীতিক সুরক্ষার লক্ষ্যে ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’কে একটি কার্যকর উপায় বলে মনে করেন লেখক। প্রস্তাবটি যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়, তা-ও স্বীকার করেছেন তিনি।

Advertisement

অচিন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২২ ১০:৩৯
Share:

দক্ষিণপন্থা: ২০২৪-এর নির্বাচনে ফের লড়বেন, ঘোষণা করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৫ নভেম্বর, ২০২২। রয়টার্স

গত তিন দশকে দেশে দেশে গণতন্ত্রের অধঃপতন যে ঘটেছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এই অধঃপতন যে কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষী মিলিটারি জেনারেলের রাষ্ট্রক্ষমতায় চড়ে বসার মধ্যে দিয়ে ঘটছে, তা কিন্তু নয়। প্রায় সর্বত্রই তা হয়েছে তথাকথিত অবাধ নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। জনগণের ভোটেই জিতে আসছেন এক প্রকার বাকচতুর আত্মগর্বী ব্যক্তিবর্গ, যাঁদের গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে ভক্তিশ্রদ্ধা নিতান্তই কম। বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে গণতন্ত্র যেন তার গুরুত্ব হারিয়েছে। এই ব্যাপারটাই ইদানীং ভাবিয়ে তুলছে তামাম সমাজবিজ্ঞানীকে। এর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে নানা ভাবে। অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে তাঁর ভাবনা লিপিবদ্ধ করেছেন আলোচ্য বইটিতে। বর্ণন, বিশ্লেষণ ও নীতি-প্রস্তাবের এক চমৎকার ঠাসবুনন বইটি।

Advertisement

এক দিকে যখন নাগরিকরা জননেতার ঐন্দ্রজালিক কুহকে আবিষ্ট, অন্য দিকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে, বা বলা ভাল, তা করে তোলা হচ্ছে। স্বয়ংশাসিত সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ কাজে হস্তক্ষেপ থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশনে পছন্দের লোক বসানো— এ ভাবেই ক্রমে প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনে অক্ষম হয়ে পড়বে। অতএব গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে আচমকা উৎপাটিত করে, নির্বাচনের তোয়াক্কা না করে, ক্ষমতা দখলের সেই গোদা পদ্ধতির এখন আর প্রয়োজন পড়ে না। হাঙ্গেরির ভিক্তর ওরবান থেকে ভারতের নরেন্দ্র মোদী— ছকটা মোটামুটি এক।

আ ওয়র্ল্ড অব ইনসিকিয়োরিটি: ডেমোক্র্যাটিক ডিসএনচান্টমেন্ট ইন রিচ অ্যান্ড পুয়োর কান্ট্রিজ়

Advertisement

প্রণব বর্ধন

৪৯৯.০০

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস

এই অভূতপূর্ব ঘটনার পিছনের কারণ হিসাবে প্রণব বর্ধন চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতির সিঁড়ির নীচের ধাপগুলির মানুষের নিরাপত্তাহীনতাকে— আর্থনীতিক, ও বিশেষত সাংস্কৃতিক নিরাপত্তাহীনতা। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান অসাম্য নিয়ে গত কয়েক বছরে বিস্তর চর্চা হয়েছে, কিন্তু অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসা তেমন চোখে পড়েনি। আর্থনীতিক নিরাপত্তাহীনতা কোভিডের মতো বিপর্যয়ের কারণেই যে শুধু ঘটে থাকে তা নয়, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে তা অন্তর্নিহিত। যেমন, বৈদেশিক বাণিজ্যের হাত ধরে আসে আপেক্ষিক সস্তা পণ্য আমদানি, প্রতিযোগিতায় পেরে না উঠে কোণঠাসা স্থানীয় শিল্প, কাজ হারানো শ্রমিক। ইউরোপ এবং আমেরিকায় দেখা গিয়েছে, যেখানে যত চিনা পণ্যের প্রবেশ, সেখানে ততই কাজ হারানো শ্রমিক, এবং তাঁদের রাজনৈতিক সমর্থন চলে যাচ্ছে দক্ষিণপন্থী কোনও দলের দিকে। অবশ্য বাম-দক্ষিণ নিয়ে এমন স্পষ্ট মেরুকরণ সম্ভব কি না, তা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। অতি বাম ও অতি দক্ষিণের মধ্যে এমন অনেক আদর্শগত অবস্থান দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলোকে সে ভাবে দাগিয়ে দেওয়া যায় না।

কী ভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই মানুষকে খানিক সুরক্ষা দেওয়া যায়, সে বিষয়ে অর্থশাস্ত্রীরা নানান নিদান দিয়ে থাকেন। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসিকে এমনই একটি ব্যবস্থা হিসাবে ভাবা হয়েছে আগে। তা যে শুধু তাত্ত্বিক ভাবনার স্তরেই আবদ্ধ ছিল তা নয়, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলিকে মোটামুটি ভাবে এই ধারণার কাছাকাছি বলে ভাবা হত। নাগরিকদের আর্থ-সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থাপনায় এই রাষ্ট্রগুলির সাফল্য অনেকটাই ভরসা জোগাত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির সমর্থকদের। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের স্রোতে সে ব্যবস্থা এখন বিপদের মুখে। চরম দক্ষিণপন্থী দলগুলি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতার বোধকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে বাম-উদারনৈতিক দর্শনের প্রতি আক্রমণে প্ররোচিত করে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয় এক অন্য ধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধকেও, যাকে বলা যায় ‘সাংস্কৃতিক’। পোশাক থেকে খাদ্যাভ্যাস, ইতিহাসের অলিগলি, অতীত গৌরবগাথা থেকে বিজিতের গ্লানি— এই সব সুচারু ভাবে ব্যবহার করে সাংস্কৃতিক নিরাপত্তাহীনতা উস্কে দেওয়া যায়। এর উদ্দেশ্য এমন এক ‘অপর’-এর নির্মাণ, যার উপরে যাবতীয় অভাববোধের দায় চাপিয়ে দেওয়া যায়।

আর্থনীতিক ব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদ সর্বব্যাপী। কিন্তু সর্বত্র যে তা একই রূপে প্রতিভাত, এমনটি নয়। রাজনৈতিক সংগঠনের দিক থেকে দেখলে মোটামুটি ভাবে দু’রকম পুঁজিবাদ দেখতে পাই— উদারনৈতিক পুঁজিবাদ, যা মূলত পশ্চিমি দেশগুলিতে দেখি; আর কর্তৃত্ববাদী পুঁজিবাদ, যার উদাহরণ চিন।চিনের কর্তৃত্ববাদী পুঁজিবাদের আর্থনীতিক সাফল্য দেখে অনেকে প্রশ্ন তোলেন, কী লাভ ওই সব উদারবাদী পুঁজিবাদকে লালন করে, যদি কর্তৃত্ববাদী পুঁজিবাদ বেশি সাফল্য দিতে পারে? বলা বাহুল্য, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র কখনও আদর্শ রাষ্ট্র হতে পারে না। প্রণববাবু এই দুই মডেলেরই সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনার শেষে তৃতীয় বিকল্পের সন্ধান দেন। উদারনৈতিক পুঁজিবাদে নির্বাচন-সর্বস্ব গণতন্ত্রের প্রকৃতির যে পরিবর্তনের কথা প্রথমেই উল্লেখ করেছি, তার কারণ খোঁজার সঙ্গে সঙ্গে লেখক সন্ধান দিয়েছেন বিকল্পেরও। সে বিকল্প এক প্রকার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি। এ প্রসঙ্গে তিনি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি এবং ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজ়ম-এর মধ্যে পার্থক্যটি সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেন। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি বলতে বুঝব মূলত একটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, যেখানে উৎপাদনের উপকরণ রয়েছে ব্যক্তি মালিকানায়, কিন্তু রাষ্ট্র সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পুঁজিকে ভদ্রসভ্য আচরণে প্রণোদিত করতে লগুড় ও গাজরের ব্যবহার যেমন থাকে, কর চাপিয়ে পুনর্বণ্টন করে মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রেরই কাজ বলে মনে করা হয়। পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে দর-কষাকষির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোটিও পোক্ত হতে হবে। অন্য দিকে, ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজ়ম আরও বৈপ্লবিক— সেখানে পুঁজির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে রাষ্ট্র, শ্রমিক সমবায় কিংবা সে রকম কোনও সংস্থার হাতে, যেখানে মুনাফার অস্তিত্ব নেই। এই পার্থক্যটির উল্লেখ করতে হল, কারণ আমেরিকায় নির্বাচনী প্রচারে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স এবং তাঁর দলবল নিজেদের ‘ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্টস’ বলতেন, যা ভুল।

সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসিকে আদর্শ বিকল্প বলেই ছেড়ে দেননি লেখক। কী করতে হবে, তা বিস্তারিত উপস্থাপন করেছেন যুক্তি ও তথ্য সহকারে। উৎপাদন সংগঠনকে গণতান্ত্রিক করে তুলতে হবে, যেখানে শ্রমিকদের কণ্ঠস্বরের গুরুত্ব থাকবে। অন্য দিকে তথ্য বলছে যে, ট্রেড ইউনিয়নগুলির দর-কষাকষির ক্ষমতা ক্রমশ কমেছে। বাজারের দখল উত্তরোত্তর বাড়িয়ে তুলে অন্যদের কোণঠাসা করা, যা এক অর্থে অগণতান্ত্রিক, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তেমন একচেটিয়া ব্যবসাও। অথচ তথ্য বলছে যে, গুটিকয়েক সংস্থার বাজারের দখল উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। কর ব্যবস্থাকে করতে হবে প্রগতিশীল, অর্থাৎ বেশি রোজগেরে ও সম্পদের মালিক আনুপাতিক হারের থেকে বেশি হারে কর দেবেন। অথচ তথ্য বলছে, ভারতে কর্পোরেট করের হার যেমন কমেছে, অন্য দিকে সম্পদ কর তুলে দেওয়া হয়েছে।

আর্থনীতিক সুরক্ষার লক্ষ্যে ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’কে একটি কার্যকর উপায় বলে মনে করেন লেখক। প্রস্তাবটি যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়, তা-ও স্বীকার করেছেন তিনি। এর পক্ষে তাঁর যুক্তিগুলি, বিপক্ষের যুক্তি এবং তার খণ্ডন— এই সব মিলিয়ে অষ্টম পরিচ্ছেদটি উৎসুক পাঠকের খুব কাজে আসবে। ইউবিআই-এর মধ্যে ওই সর্বজনীন ব্যাপারটিকে অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। কি গরিব, কি বড়লোক— সবাই সমান পরিমাণ টাকা পাবেন, এ কেমন কথা? প্রণব বর্ধন যে রকম চমৎকার ভাবে যুক্তিগুলি সাজিয়েছেন, তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে, তাঁর সঙ্গে সহমত না হলেও।

বইটি মানব-সুরক্ষার লক্ষ্যে এক চমৎকার ব্লুপ্রিন্ট, যাকে ‘এঞ্জিনিয়ারিং’ নয়, রাজনৈতিক অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে। সেখানেই বইটির অনন্যতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন