চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

আলো-আঁধারেও বর্ণময় প্রাণের উদ্ভাস

আকার প্রকার গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ সংবৃতির মধ্য দিয়েই, অর্থাৎ বাহুল্যকে কমিয়ে আনতে আনতেই শিল্পকলা শুদ্ধতার দিকে যায়। এই প্রক্রিয়ার শ্রেষ্ঠ এক দৃষ্টান্ত গণেশ হালুই-এর ছবি। সম্প্রতি আকার প্রকার গ্যালারিতে তাঁর দুটি ভাস্কর্য-সহ একগুচ্ছ সাম্প্রতিক ছবি দেখতে দেখতে এই সত্যটিই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘দ্য ফিলিং আই’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

সংবৃতির মধ্য দিয়েই, অর্থাৎ বাহুল্যকে কমিয়ে আনতে আনতেই শিল্পকলা শুদ্ধতার দিকে যায়। এই প্রক্রিয়ার শ্রেষ্ঠ এক দৃষ্টান্ত গণেশ হালুই-এর ছবি। সম্প্রতি আকার প্রকার গ্যালারিতে তাঁর দুটি ভাস্কর্য-সহ একগুচ্ছ সাম্প্রতিক ছবি দেখতে দেখতে এই সত্যটিই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘দ্য ফিলিং আই’। চোখ শুধু দেখেই না। সেই দেখাকে অনুভবে রূপান্তরিত করে। শিল্পের শুদ্ধ সত্তা নিহিত থাকে সেই অনুভবের মধ্যে। অনেক দিন আগে ১৯৯৫ সালে একটি ইংরেজি দৈনিকের সাক্ষাৎকারে গণেশ হালুই বলেছিলেন— এক দিকে বাইরের দৃশ্য-জগতের জ্যামিতি, অন্য দিকে অদৃশ্যমান অন্তর্লোকের নিহিত ছন্দের জ্যামিতি, এই দুইয়ের মধ্যে এক ধরনের যোগসূত্র বা সংযোগের সেতু হল তাঁর ছবি।

Advertisement

নিসর্গের শ্রেষ্ঠ এক রূপকার হিসেবেই এক সময় পরিচিত ছিলেন এই শিল্পী। ১৯৭১ থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত নিসর্গ রচনার ক্রমিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাঁর খ্যাতি সারা ভারতে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। সেই নিসর্গ ছিল কোনও এক সজল ও শ্যামল ভূখণ্ডের। অধিকাংশ ছবিই ছিল নির্জন। আলো ও অন্ধকারের দ্বৈত ছিল তাতে। ছিল বর্ণের প্রাণময় উদ্ভাস। এই উদ্ভাস এমন এক পরিমণ্ডল রচনা করত, যাকে কবির ভাষায় বলা যায়— ‘সেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ — সবচেয়ে গাঢ় বিষণ্ণতা।

এ রকম বর্ণনাত্মক নিসর্গ বিষয়ের বাহুল্য বর্জন করে সংবৃতির দিকে বা আপাত-নিরবয়বের দিকে যেতে শুরু করল ১৯৮০-র দশকের একেবারে শেষ পর্যায় থেকে। ১৯৮৯-এর ডিসেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত একটি এককে দেখা গেল নিসর্গের সারাৎসারকে আত্মস্থ করে এক প্রায়-বিমূর্ত জ্যামিতিক বিন্যাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তাঁর ছবি। এই বিমূর্ততা ক্রমান্বয়ে পরিশীলিত হয়েছে ১৯৯০-এর দশক জুড়ে। এ শুধু দৃশ্যতার বিমূর্তায়ন নয়, এর ভিতর আত্মস্থ হয়েছে এক সংবৃতির দর্শন, যা তিনি অর্জন করেছেন ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত অজন্তায় প্রতিলিপি রচনার কাজে যুক্ত থাকার সূত্রে।

Advertisement

শিরোনাম ‘মাই নেম ইজ কালমা’। মায়ের হাত ধরে একটি শিশু খেলনা হাতে করে আনন্দে হাঁটছে। ছবিটির মধ্যে একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা আছে। অজয় ঘোষ ওয়াশে এঁকেছেন ‘মহাপ্রয়াণ’। রূপায়ণের নম্রতা মরণকে মহিমান্বিত করেছে।

অমল নাথ চাকলাদার ১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত নব্য-ভারতীয় ঘরানার একজন বিশিষ্ট শিল্পী, ঐতিহ্যের ভিতর যিনি সূক্ষ্মভাবে আধুনিকতাকে সঞ্চারিত করেছেন। টেম্পারায় আঁকা তাঁর ‘দুর্গার মুখ’ ছবিটি সেই বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। শঙ্করনাথ আইচের টেম্পারা ‘অর্ধনারীশ্বর’ সুললিত লাবণ্যে ভরা পরিচিত রূপরীতির দৃষ্টান্ত। শুক্তি শুভ্রা প্রধান টেম্পারায় এঁকেছেন ‘মা ষষ্ঠী’। একটি ঘটকে রূপান্তরিত করেছেন দেবীমূর্তিতে। তাঁর জ্যামিতিক বিন্যাস উপভোগ্য। দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ওয়াশে ধ্যানমগ্ন দেবমূর্তি এঁকেছেন। মনোজকুমার দত্ত পেনসিলে এবং সুদীপ নন্দী জলরঙে এঁকেছেন সমকালীন নিসর্গের ছবি। দুজনেরই মাধ্যমের উপর দক্ষতা লক্ষনীয়।

অঞ্জনা দত্ত অ্যাক্রিলিকে এঁকেছেন ‘বডিস্কেপ’ শিরোনামে ছবি। ঐতিহ্যের ভিতর তিনি আধুনিক রূপবোধ সঞ্চারিত করেছেন। মূর্ত ও বিমূর্তের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়েছেন। নব্য-ভারতীয় ঘরানার এই প্রসারণ আজ প্রয়োজন। সৌমেন খামরুই সাধারণত এই প্রসারণ নিয়েই কাজ করে থাকেন। কিন্তু এই প্রদর্শনীর ওয়াশে করা ‘শিবকন্যা’ শীর্ষক ছবিতে ধীরেন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই তিনি হয়তো প্রথাগত ভারতীয় রীতিতে কাজ করেছেন। তাঁর রূপায়ণের নম্রতা ও শুদ্ধতা অনস্বীকার্য।

অজন্তার আঙ্গিক অনুসরণ করেছেন পার্থসারথি ভট্টাচার্য টেম্পারায় আঁকা তাঁর ‘ড্রিম ইন লোটাস লিভস’ ছবিতে। সৌরদীপ সাহা-র ওয়াশে প্রদীপ-শিখাটি ‘বিশ্বাস’-এর প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। তাঁর ছবির শিরোনাম ‘ফেইথ’। কৌশিক কুমার গুয়াশ মাধ্যমে এঁকেছেন কৃষকের কুটিরের আলেখ্য। ঘরের পিছনে বাঁশঝাড়। সামনে ধানের গোলা। একটি গরু দাঁড়িয়ে আছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটি মুরগি। দেওয়ালে ঘুঁটে দেওয়া। সব্যসাচী বোরা-র টেম্পারার নিসর্গ-রচনাটিও প্রথাগত আঙ্গিকের প্রসারণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন