Book

Book Review: ‘ছোটোলোক’ বড় হয় কীসে? তা কি যৌনতা, না আরও কিছু?

প্রান্তবঙ্গকে ‘ভদ্রলোক’-এর ছাপ মারা সংস্কৃতি কিছুতেই যে দলে নেয় না, সেই রাজনীতিটিকে শৈশবের চোখ দিয়েই দেখিয়েছেন ‘ছোটোলোক’।

Advertisement

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২২ ০৯:৩৯
Share:

‘ছোটলোক’ কথাটির দু’টি ভিন্নার্থ হয়। একটি ‘ছোট’ অর্থাৎ মাপে বা বয়সে ছোট অর্থে। আর দ্বিতীয়টি ‘ঊণ’ বা ‘ন্যূন’ অর্থে। প্রথমটির বিপরীত হওয়া উচিত ‘বড়’ আর দ্বিতীয়টির ‘ভদ্র’।

Advertisement

এই কথা ক’টিই বিভিন্ন প্যাঁচে উঠে এসেছে ‘ছোটোলোক: জনৈক ছোটোলোকের বড় হয়ে ওঠা’ নামের গ্রাফিক উপন্যাসটিতে। বাংলায় গ্রাফিক উপন্যাসের তেমন চল এখনও ঘটেনি। কিন্তু ১১২ পাতার এই বইটিকে ‘ছবিতে গল্প’ ছাড়া আর কিছুই যে বলা যায় না, তা এর পাতা ওলটালেই বোঝা যায়।

উল্লেখ্য, বইটির লেখক কোথাও নিজের নাম ব্যবহার করেননি। এমনকি, আখ্যাপত্রেও ‘লেখক’ হিসেবে ‘ছোটোলোক’ নামটিই ছাপা রয়েছে। সেদিক থেকে দেখলে এই বই এমন এক ব্যাক্তিমানুষের স্বগতকথন, যিনি নিজেকে ‘বড়লোক’ (বা ‘বড়’ লোক) বলে ভাবতে রাজি নন। অন্ততপক্ষে, এই বইয়ে বিধৃত ‘কাহিনি’-র কালে তো নয়ই।

Advertisement

পাতা ওলটাতে গেলে মনে পড়তে পারে সুকুমার রায়ের ‘পরীক্ষায় গোল্লা পেয়ে হাবু ফেরেন বাড়ি’-র কথা। অথবা আজকের বিশ্বে জনপ্রিয় সিরিজ ‘ডায়েরি অব আ উইম্পি কিড’। কিন্তু এই দুইয়ের সঙ্গে ‘ছোটলোক’-এর এক জায়গায় মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ‘ছোটলোক’ অন্য দু’টির মতো ‘অমল গানের বই’ নয়। বরং এতে বর্ণিত কাহিনি জনৈক নাবালকের সাবালকত্ব প্রাপ্তির গল্প। তার চোখ দিয়ে ‘বড়’ লোকদের দেখার গল্প। আর সেই গল্পে অবধারিত ভাবে প্রবেশ করেছে যৌনতা তার একাধিক বর্ণালি নিয়ে। এই যৌনতা বা বলা ভাল ‘যৌনতার বোধ’-ই ‘ছোট’-কে ‘বড়’ করে তুলতে পারে, সেই চিরায়ত সত্যিকেই নিজের মতো করে বলেছে এই কাহিনি। সেই সঙ্গে তুলে এনেছে আরও কিছু ‘ঊন’-মানুষের কথা, যাদের সে অর্থে ‘বড়’-লোকেরা তাদের চৌহদ্দিতে ঠাঁই দেয় না।

কাহিনির পটভূমি ডিসেরগড় নামক এমন এক জায়গায়, যাকে ‘প্রান্ত বাংলা’ বলা যায়। আর কাহিনির কাল ১৯৮০-র দশক । যে সময় ক্যামেরা, ক্যাসেট প্লেয়ার বা ‘ডিস্কো ডান্সার’ ছবির গান কাহিনিতে বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ। কাহিনির কথক বা কেন্দ্রীয় চরিত্র এমন একজন, যে শৈশব ও বাল্যের মাঝামাঝি এক অনির্দেশ্য স্থানে বাস করছে। ডিসেরগড়ের নিজস্ব ভাষাকে তার অধ্যাপক বাবা-মা অস্বীকার করেন। কিন্তু কথকের দেখশোনারত ‘দিদি’ সেই ভাষাতেই কথা বলে।

এখানেই সম্ভবত ঘটে যায় বিভাজন। প্রান্তবঙ্গকে ‘ভদ্রলোক’-এর ছাপ মারা সংস্কৃতি কিছুতেই যে দলে নেয় না, সেই রাজনীতিটিকে শৈশবের চোখ দিয়েই দেখিয়েছেন ‘ছোটোলোক’। বাবার বন্ধুদের বাড়িতে আগমন বা তাদের মদ্যপান এখানে খুব ঘোরতর ঘটনা নয়, যতখানি কথকের মামার একটি ক্যাসেট প্লেয়ার সমেত আগমন ও ‘ডিস্কো ডান্সার’-এর গান চালানো ‘ভদ্রেতর’ কাজ হিসেবে বিবেচিত। এখানেই কোথাও একটা সাংস্কৃতিক বিভাজন ঘটে যায়। কথক তার এক প্রতিবেশী জেঠুর কাছে ‘অপসংস্কৃতি’-র অর্থ জানতে চায়। জেঠু তাকে বোঝান ‘কালচার’-এর অর্থ সংস্কৃতি। কিন্তু ‘কালচার’-এর গভীরে রয়েছে ‘কর্ষণ’-এর ধারণা। সুতরাং ‘কালচার’-এর বাংলা ‘কৃষ্টি’ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তা কিছুতেই হয় না। ‘কালচার’ আটকে থাকে ‘সংস্কৃতি’-তেই । ফলে ছোটলোকদের কর্ষিত ‘জমি’ আর ‘বড়’-লোকদের সংস্কৃতির ‘ভূমি’— এই দুই ক্ষেত্র সম্পূর্ণ আলাদা হয়েই পড়ে থাকে। আর এই দুই পরিসরের মাঝখানে কাটতে থাকে ‘ছোটলোক’-এর জীবন।

‘বড়’-দের জগৎটিও যে একমাত্রিক নয় তা কথক টের পায় আচমকাই। রেডিয়োতে ‘অয়দিপাউস’ নাটক শুনতে গিয়ে সে আবিষ্কার করে বসে এক নিষিদ্ধ জগতের অস্তিত্ব। বড়দের ‘খেলা’ বলে এমন এক বস্তু রয়েছে, যা তার কাছে বা তাদের মতো ‘ছোট’-দের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তার দেখাশোনা-করা দিদি যে কথা অবলীলায় বলতে পারে, তা অন্যরা পারে না। গ্রুপ-ডি কর্মীর মেয়েকে যে কথা অবলীলায় বলে ফেলতে পারে ‘বড়’ দাদা, আর যে ভাষায় সেই মেয়ে তার জবাব দেয়, তা এক অনির্দেশ্য পরিসর। সেখানে বোঝা আর না-বোঝার বিষয়গুলি খুব সূক্ষ্ম পর্দার আবডালে বিরাজ করে। এ ভাবেই দুই ‘বড়’ দাদাকে সমকামী খেলায় রত হতে দেখে ‘ছোটলোক’ রোমাঞ্চিত হয়। কিন্তু তাকে সেই খেলায় না নেওয়ায় সে নিজের সম্পর্কে হীনন্মন্যতায় ভুগতে থাকে। জেঠু তাকে এক ফ্যান্টাসির আখ্যান শোনান। সেই আখ্যান ‘উড়ান’ থেকে পতিত হওয়ার কাহিনি। কীসের ‘উড়ান’? তা কি প্রতীকী কিছু? তাকি পৌরুষের উজ্জীবন? অকৃতদার (বিপত্নীকও হতে পারেন) সেই জেঠু আর কথক ‘ছোটোলোক’ কোথাও যেন এক বিন্দুতে উপনীত হয়।

এরই ফাঁকে কাহিনিতে প্রবেশ করে কথককে স্কুলে ভর্তি করানোর কথা। ‘বর্ণপরিচয়’ আর ‘সহজপাঠ’-এর গণ্ডি ছাড়িয়ে এমন এক জগতে প্রবেশ করানোর ‘চক্রান্ত’ ঘনিয়ে ওঠে, যাকে এড়ানো ‘ছোটোলোক’-এর পক্ষে সম্ভব নয়। এই সময়েই সে প্রত্যক্ষ করে এক যুবক ও যুবতীর মিলনদৃশ্য। তার ‘উজ্জীবন’ ঘটে। সে টের পায়, সে আর ‘ছোটোলোক’-এর সংজ্ঞা-সীমায় আবদ্ধ থাকছে না। সে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ‘বড়’-লোকদের পৃথিবীতে। এর পরেই ঘটে সেই অনিবার্য ঘটনা। শুর হয় স্কুলজীবন। সে আক্ষরিক অর্থেই ‘বড়’ হয়ে ওঠে।

এই কাহিনি এমন এক সময়ের, যাকে উত্তর-বিশ্বায়ন পর্ব বিশ্বাস করতেই পারবে না। এই পর্বে বদল হয়ে গিয়েছে অনেক কিছুর সংজ্ঞা। ফলে ‘ছোটলোক’ আর তার নির্ধারিত সীমার অর্থে আটকে নেই। ‘বড়’ শব্দটিরও ব্যঞ্জনা বদলে গিয়ছে। এই ছবি-কাহিনির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সেই কথাই বারবার মনে হতে পারে পাঠকের। ১৯৮০-র দশকে শৈশব-বাল্য-কৈশোর পেরনোর দল এই বইয়ে খুঁজে পেতে পারেন হারিয়ে যাওয়া অনুভূতির মিছিলকে। নতুন প্রজন্মের পাঠক সন্ধান পেতে পারেন এক হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার। ডিসেরগড় এখানে হয়ে উঠতে পারে পড়ে-থাকা সময়ের এক অভিজ্ঞান। বাস্তবের ডিসেরগড়ের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক না-ও থাকতে পারে। এই সব বিবিধ অনির্দেশ্য বিষয়কে, বলতে না চাওয়া অনেক বিষয়কে, বলতে না পারা অঢেল বিষয়কে বিচিত্র রেখাভঙ্গে আর লিখনে ধরে রাখল এই বই। বাংলা বইয়ের জগতে এ এক ব্যতিক্রমী ঘটনা তো বটেই!

ছোটোলোক: জনৈক ছোটোলোকের বড় হয়ে ওঠা/ ছোটোলোক/ খোয়াবনামা/ ১০০টাকা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন