চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

সামাজিক আলোড়নে জীবনের যে বিপর্যয়

ইলিনা বণিকের ছবিতে ভাবনা ও আঙ্গিক দু-দিক থেকেই একাধিক অভিমুখ আছে। তাঁর মূলগত ভাবনা জীবন-কেন্দ্রিক। সামাজিক আলোড়নে জীবনের যে বিপর্যয়, মানবতার যে অবক্ষয়, এর বিরুদ্ধে গভীর এক প্রতিবাদীচেতনা সব সময়ই তাঁর ছবির প্রেক্ষাপটে থাকে। এর পাশাপাশি তিনি সন্ধান করেন উজ্জীবনের আলো। ক্রমমুক্তির সম্ভাবনাকেও তিনি নানা দিক থেকে উন্মীলিত করতে চান। কখনও যীশুর প্রতীকে, কখনও শিশু, ফুল, নদীর প্রতিমায় সৌন্দর্যের অবিনশ্বর স্পন্দনের বার্তা মেলে ধরেন। আর তাঁর ছবিতে ধ্রুপদের মতো আসেন রবীন্দ্রনাথ।

Advertisement

আইসিসিআর-এ অনুষ্ঠিত হল ইলিনা বণিকের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ।

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৫ ০০:০১
Share:

ইলিনা বণিকের ছবিতে ভাবনা ও আঙ্গিক দু-দিক থেকেই একাধিক অভিমুখ আছে। তাঁর মূলগত ভাবনা জীবন-কেন্দ্রিক। সামাজিক আলোড়নে জীবনের যে বিপর্যয়, মানবতার যে অবক্ষয়, এর বিরুদ্ধে গভীর এক প্রতিবাদীচেতনা সব সময়ই তাঁর ছবির প্রেক্ষাপটে থাকে। এর পাশাপাশি তিনি সন্ধান করেন উজ্জীবনের আলো। ক্রমমুক্তির সম্ভাবনাকেও তিনি নানা দিক থেকে উন্মীলিত করতে চান। কখনও যীশুর প্রতীকে, কখনও শিশু, ফুল, নদীর প্রতিমায় সৌন্দর্যের অবিনশ্বর স্পন্দনের বার্তা মেলে ধরেন। আর তাঁর ছবিতে ধ্রুপদের মতো আসেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর কাছে উজ্জীবনের প্রধান এক উৎস। তাঁর ছবি মূলত অবয়বী। ইলিনা ১৯৯০-এর দশকের একেবারে শেষ পর্বে সক্রিয় থেকেছে। একটা সময় অবশ্য পোস্ট-মডার্ন কনসেপচুয়াল আর্টের কিছু বৈশিষ্ট্য তিনি আয়ত্ত করতে চেষ্টা করেছেন। সেটা তাঁর পূর্বোক্ত পদ্ধতির সঙ্গে সমন্বিত হয়ে তাঁর রূপরীতিতে এক স্বতন্ত্র অভিমুখ এনেছে। এই সমন্বয়ের ভিতর দিয়েই গড়ে তুলেছেন নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি।

Advertisement

আইসিসিআর-এর বেঙ্গল গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর একক প্রদর্শনী ‘দি ইনফিনিট অ্যাডভেঞ্চার’। ‘অন্তহীন অভিযাত্রা’র কিছু ইঙ্গিত তাঁর এবারের চিত্রমালায় আছে। নানা ভাবনাকে তিনি ধরতে চেষ্টা করেছেন। একটি ভাবনাকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সেখানে তিনি তাঁর একক মাতৃত্বের কথা বলেছেন। সেই মাতৃত্বের নানা প্রতিফলন রেখেছেন আলোচ্য প্রদর্শনীতে। সঙ্গে রেখেছেন তাঁর আড়াই বছর বয়সের কন্যার ছবিও। শান্তিনিকেতনের উত্তরাধিকার নানা ভাবে কাজ করেছে ইলিনার ছবিতে। ১৯৯৭-তে তিনি কলাভবন থেকে স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেছেন। ১৯৯০ থেকে প্রায় সাত বছর শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁর সংযোগ তাঁর জীবন ও শিল্পে নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছে।

মা ও শিশুর কয়েকটি ছবিতে তিনি মাতৃত্বের আনন্দের পাশাপাশি একক মাতৃত্বের তথাকথিত সামাজিক প্রতিরোধের যন্ত্রণাকেও ব্যক্ত করেছেন। ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড অ্যান্ড দি অনলুকারস’ শীর্ষক দুটি ছবি এই দ্বান্দ্বিকতার দৃষ্টান্ত। শায়িতা মা ও শিশুর রূপায়ণে তিনি দুজনের অবয়বকেই জ্যামিতিক কতগুলি তলে ভেঙেছেন, যা অনেকটা বিশ্লেষণাত্মক ঘনকবাদের অনিসারী। পিছনে রয়েছে কিছু সন্ত্রস্ত, অভিব্যক্তিদীর্ণ পুরুষ ও নারীর মুখ, থেখানে লিপ্ত হয়ে আছে শঙ্কা ও সন্দিগ্ধতা। ‘দি সাইন অব থান্ডার’ ছবিটির গঠনপ্রক্রিয়াও অনেকটা সমধর্মী। ‘রেড ক্রাইস্ট’ শীর্ষক একটি ক্যানভাসেও লোহিতবর্ণের প্রিস্টের তলায় শঙ্কাকুল লতার জটলা দেখা যায়। এবারের প্রদর্শনীতে কিছু ছবি রয়েছে যেখানে সাদা-কালোতে নিসর্গের সঙ্গে কবিতাকে মিলিয়েছেন। লিখনভঙ্গি বা ক্যালিগ্রাফি বিশেষ এক মাত্রা সঞ্চার করেছে এসমস্ত রচনায়। সেরকম একটি ছবিতে আমরা উৎকীর্ণ দেখি এরকম রবীন্দ্রগানের বাণী: ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে
কে যায়
বিদেশী নায়ে
’।
অন্য একটি ছবিতে রয়েছে জীবনানন্দের নিসর্গ-তন্ময়তা:
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো
কিশোর এক
শাদা ছেড়া পালে ডিঙা বায়
’।
প্রকৃতি ও কবিতার এই সহাবস্থানের মধ্য দিয়েই তিনি মানবিক উজ্জীবনের সম্ভাবনাকে উন্মীলিত করেন। ফুল আসে তাঁর ছবিতে বারাবার। ফুলের মধ্য দিয়ে শিশুর কল্পনার জগতের কল্পরূপকেও তিনি নিয়ে আসেন। এর বিপরীতে অনেক সময়ই থাকে মানবিক লাঞ্ছনার প্রতিমাকল্প। ‘অ্যান্ড দ্য ফ্লাওয়ারস’ এর দৃষ্টান্ত।

Advertisement

ইলিনার আড়াই বছরের কন্যার নাম অমরাবতী। মায়ের পাশাপাশি সে-ও এই প্রদর্শনীর সমান অংশীদার। এ বয়সের শিশুর ছবিতে প্রাধান্য পায় উদ্দেশ্যহীন আঁকিবুকি। তা থেকেই গড়ে ওঠে অত্যন্ত তন্ময় ও অভিব্যক্তিবাদী বিমূর্ত এক রূপ। অমরাবতীর ছবিগুলি এই আঙ্গিকের। জলরঙে যেমন সে কিছু ছবি এঁকেছে তেমনি এঁকেছে অস্বচ্ছ অ্যাক্রিলিক রঙেও। এরকম ছবিতে শিশুমনের অজানা রহস্য উঠে আসে। একজন প্রতিষ্ঠিত প্রাপ্তবয়স্ক শিল্পী অনেক সময়ই এই স্বতঃস্ফূর্ত সারল্যের দিকে যেতে চান। কিন্তু পিকাসো যেমন বলেছিলেন সেটা খুব কঠিন কাজ। শিশুর ছবির এটাই প্রথম পর্যায়, যার নাম দেওয়া হয় ‘স্ক্রিবলিং’। তিন বছর বয়স থেকে শিশু কিছু কিছু অবয়ব তৈরি করতে পারে। পাঁচ বছর বয়স থেকে আসে সেই অবয়বের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করার একটা পর্যায় যাকে বলা হয় ‘সিম্বলিজম’। অমরাবতী সেই পর্যায়গুলোতে আসবে ধীরে ধীরে। তার আগেই মায়ের সঙ্গে তাঁর এই যুগলবন্দি শিল্পের জগতে তাঁকে পরিচিত করল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন