পুস্তকপরিচয় ৩

আর দ্বিতীয়টি মেলে না

সুবর্ণরেখা জায়গাটা বস্তুত কী? কী তার ঐকান্তিক ও বিশেষ স্বরূপ? বইয়ের দোকান— তা নতুন, না পুরোনো বই? পত্রিকা অফিস— তা-ও পুরোপুরি কি? নাকি তা নানা বয়সের কবি, সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিকের আড্ডার ঠেক?’ প্রশ্ন তুলেছেন অনিরুদ্ধ লাহিড়ী, তাঁর ‘ইন্দ্র-চরিত: কয়েকটি টুকরো’ লেখায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১
Share:

ঘটিগরম, ইন্দ্রনাথ মজুমদার। সপ্তর্ষি প্রকাশন, ১৫০.০০

সুবর্ণরেখা জায়গাটা বস্তুত কী? কী তার ঐকান্তিক ও বিশেষ স্বরূপ? বইয়ের দোকান— তা নতুন, না পুরোনো বই? পত্রিকা অফিস— তা-ও পুরোপুরি কি? নাকি তা নানা বয়সের কবি, সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিকের আড্ডার ঠেক?’ প্রশ্ন তুলেছেন অনিরুদ্ধ লাহিড়ী, তাঁর ‘ইন্দ্র-চরিত: কয়েকটি টুকরো’ লেখায়। ইন্দ্রনাথ মজুমদারকে নিয়ে সদ্য-প্রকাশিত ঘটিগরম বইটির অর্ধেকেরও বেশি জুড়ে রয়েছে এই অনবদ্য লেখাটি: জীবনীর ‘কালানুক্রমিক ধারাবাহিকতা’ না থাকলেও ‘বান্ধবজনের মনের পটে আঁকা মুখের জীবন্ত আদল’ তাতে বড় চমৎকার ফুটে উঠেছে। পড়তে পড়তে অনিরুদ্ধবাবুর মতোই প্রশ্ন তুলতে ইচ্ছে করে, ইন্দ্রনাথ মজুমদার আসলে কে? বন্ধুবৎসল, দিলখোলা, খাদ্য ও পানীয়রসিক, পায়ের তলায় সর্ষে? পুরনো বইয়ের পোকা, বই-ব্যবসায়ী, ভিন্ন ঘরানার বইয়ের প্রকাশক? পুরনো বই যাঁরা নিছক ভালবেসে অথবা গবেষণার প্রয়োজনে সংগ্রহ করেন তাঁদের সাহায্য করতে সদা-তৎপর? অনিরুদ্ধবাবুর ভাষায়, ‘ইন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এসেছে, অথচ মুগ্ধ হয়নি, এরকম হার্মাদ অন্তত আমার জানা নেই।’

Advertisement

কোনও জীবনচরিতেই কাউকে পুরোপুরি পাওয়া যায় না। তবু, যা পাওয়া গেল, তা-ও অনেক। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের প্রায় অর্ধশতকের সুহৃদ অনিরুদ্ধ লাহিড়ী যেমন তুলে এনেছেন অজস্র হীরকখণ্ড, জহর সরকার কি গৌতম ভদ্র শুনিয়েছেন আরও অনেক গল্প। আর বইয়ের আসল অংশে তো স্বয়ং ইন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণ ‘ঘটিগরম’। ছোট থেকেই পুরনো বইয়ের নেশা, লাইব্রেরি তৈরি করা, সেখান থেকে বইয়ের ব্যবসা, কলকাতা আর শান্তিনিকেতনে ‘সুবর্ণরেখা’র পত্তন, মতি নন্দীর পরামর্শে বই ছাপা শুরু, কমলকুমার মজুমদার থেকে শক্তি-সুনীল-বেলাল চৌধুরী কত জনের সঙ্গে যোগাযোগ, খালাসিটোলা— জীবনস্মৃতির কত না খোলা পাতা। সঙ্গে তাঁরই আরও চারটি ছোট লেখা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আরও কথা, এ কালের সংগ্রাহকদের কথা। আছে সৌম্যেন পালের নেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটিও।

সব মিলিয়ে টুকরো টুকরো ছবির বহুবর্ণ অ্যালবাম। ঠাকুরমা-র দেওয়া নাম ‘মৃদুল’ পাল্টে নিজেই করে দিলেন ‘ইন্দ্রনাথ’। ক্লাস এইটের পর আর পড়াশোনা হয়নি। কেন? ‘দূর, ফার্স্ট হতে আর ভালো লাগল না, তাই।’ গ্রন্থাগার আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন— পরে কত শত গ্রন্থাগারের ভাঙাগড়া তাঁরই হাতে! আর পুরনো বই কেনা বেচা? গৌতম ভদ্র লিখেছেন, ‘ইন্দ্রনাথ বই দেখতেন, বইতে কোনও-না-কোনও পাঠকের মুখ ভেসে উঠত, পাতা ও মুখ একাকার হয়ে যেত।... ঠিক ঠাহর করে ইন্দ্রনাথ সর্বোত্তম পাঠকের কাছে তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বইটা পৌঁছে দিতেন।... দেবার সময় নিজে একগাল হেসেছেন, ওই হাসতে পারাটাই যেন তাঁর পরম প্রাপ্তি।’ বিদগ্ধজনের পাশাপাশি সাধারণ পাঠক, বইলিপ্সুদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহারে কোনও তারতম্য ছিল না। এতটা ভালবাসা যে মানুষটি পেলেন, চরিত্রের সেই জাদু হয়ত ছিল এখানেই।

Advertisement

ইন্দ্রনাথ মজুমদারের মতো মানুষকে পৃথিবী একবারই পায়, আর দ্বিতীয়টি মেলে না, গৌতম ভদ্রের এই মন্তব্য ঘটিগরম আবার মনে করিয়ে দিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement