চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

ভারতীয় ধ্রুপদী ঐতিহ্যের সঙ্গে কারুশিল্পের মেলবন্ধন

ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘সফরনামা’ প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের দশ-বছর পূর্তি উপলক্ষে সেখানে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল বস্ত্রশিল্পের আঙ্গিকের অভিনব প্রদর্শনী ‘সফরনামা’। একটি ‘জার্নিজ থ্রু আ কলমকারি হ্যাঙ্গিং’, অন্যটি ‘কনটিনিউইং ট্রাডিশনস’। বস্ত্রশিল্প বিশ্ব জুড়ে দৈনন্দিনতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত। এটি এমন একটি কারুশিল্প, যার উত্‌স সুদূর অতীতে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share:

কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের দশ-বছর পূর্তি উপলক্ষে সেখানে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল বস্ত্রশিল্পের আঙ্গিকের অভিনব প্রদর্শনী ‘সফরনামা’। একটি ‘জার্নিজ থ্রু আ কলমকারি হ্যাঙ্গিং’, অন্যটি ‘কনটিনিউইং ট্রাডিশনস’।

Advertisement

বস্ত্রশিল্প বিশ্ব জুড়ে দৈনন্দিনতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত। এটি এমন একটি কারুশিল্প, যার উত্‌স সুদূর অতীতে। দেশভেদে, জাতিভেদে মানুষের রুচি ও আত্মপরিচয়ের একটি স্মারক ও তাঁর ব্যবহৃত বস্ত্র, ঐতিহ্য ও সমকালীন মূল্যবোধের নিরন্তর সংশ্লেষ চলে বস্ত্রশিল্পের মধ্যে। একে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি যন্ত্রে বোনা, যন্ত্র আবার দু’রকম: হস্তচালিত তাঁত ও যন্ত্রচালিত তাঁত বা পাওয়ার লুম। আর একটি হাতে আঁকা বা ছাপা। হাতে আঁকা বস্ত্রের একটি ধারাকে বলা হয় ‘কলমকারি’। এই প্রদর্শনীতে সেই আঙ্গিকেরই কিছু কাজ দেখানো হয়েছে। কলমে এঁকে অলংঙ্করণের যে বস্ত্রশিল্প সেটাই ‘কলমকারি’।

এখানে যে ‘কলমকারি’ আঙ্গিকের বস্ত্র প্রদর্শিত হয়েছে সেগুলি দক্ষিণ-ভারতের পরম্পরাগত রীতিতে আঁকা হয়েছিল সপ্তদশ শতকে। তার পর সেগুলি করমন্ডল উপকূল থেকে ফরাসি শহর ‘মুলহাউস’-এ চলে যায় এবং সেখানকার ‘মিউজিয়ম অব প্রিন্টেড টেক্সটাইল’-এ সংগৃহীত হয়। তারই কিছু নিদর্শনফরাসি সরকার ও উক্ত সংগ্রহালয়ের সৌজন্যে এখানে প্রদর্শিত হল ‘হাই-রেজলিউশন ডিজিটাল প্রিন্ট্স’-এর মাধ্যমে। এই কলমকারি রচনাগুলি বাঁশের ডালপালা থেকে তৈরি কলম দিয়ে আঁকা এবং সমৃদ্ধ ‘চিনটস’ ডিজাইনের অন্তর্গত। পশু-পাখি-বৃক্ষ-লতা-ফুল ফলে শোভিত এই অলঙ্করণে তাই, পারস্য, থাই, চিন, জাপান, মালয় ইত্যাদি বহু প্রাচ্য ঐতিহ্য সমন্বিত হয়েছে। বস্ত্র এভাবেই হয়ে ওঠে মানুষের সামগ্রিক সৌন্দর্য চেতনার স্মারক। প্রদর্শনীটি পরিকল্পনা করেছেন ড. লতিকা ভরদরাজন।

Advertisement

এই যে আমাদের সুদূর ঐতিহ্যবাহিত বস্ত্রশিল্প, তা আমাদের সাম্প্রতিক চিত্রকলাকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেছে। সেই সংযোগেরই কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে এই প্রদর্শনীর দ্বিতীয় অংশে, যার শিরোনাম ‘কনটিনিউইং ট্রাডিশনস’। এটি কিউরেট করেছে আকার প্রকার গ্যালারি। পাঁচ জন শিল্পীর কাজ ছিল এখানে। আদিত্য বসাক, জয়শ্রী চক্রবর্তী, পলা সেনগুপ্ত, শ্রাবণী রায় ও অর্চনা হান্ডে। পোস্ট-মডার্ন ভাবনাকে আমাদের সমকালীন শিল্পীরা যেভাবে আত্মস্থ করেছেন, তাতে ঐতিহ্যের নতুন মূল্যায়ন-প্রবণতা আছে, যা অন্তত ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত আধুনিকতাবাদী ভাবনার যে বিস্তার, তা থেকে আলাদা। এই পাঁচজন শিল্পীর কাজে সেই আত্তীকরণের পাঁচটি অভিমুখ আমরা দেখতে পাই।

আদিত্য বসাক তাঁর কাজে মুদ্রণ-শিল্পের ঐতিহ্য ও প্রকরণকে নানাভাবে আত্মস্থ করেছেন। সেই দৃষ্টিকোন থেকেই তিনি এখানে উপস্থাপিত করেছেন দুটি ছবি, যাতে ক্যানভাসের উপর তিনি কাজ করছেন অ্যাক্রিলিক, টেম্পারা, কাঠ ও ডিজিটাল প্রিন্টের সমন্বিত প্রয়োগে এঁকেছেন পরম্পরাগত এক নারীর, প্রতিমাকল্প, যাঁর বস্ত্রাবরণকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন। জয়শ্রী চক্রবর্তীর সাম্প্রতিক ছবিতে বয়নশিল্পের বিশেষ প্রভাব আছে। এখানে তাঁর নিসর্গ-ভিত্তিক বিমূর্ত রচনায় কাপড়, আঠা, অ্যাক্রিলিক, নেপালি-কাগজ, গাছের শিকড় ইত্যাদি নানা উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। পলা সেনগুপ্ত তাঁর এখনকার রচনায় নারীবিশ্বকে উন্মীলিত করতে বয়নশিল্পকে নানা ভাবে ব্যবহার করে থাকেন। এখানে কয়েকটি রচনায় তিনি সেই উত্‌সেরই নির্যাস নিয়ে অলঙ্করণময় প্রতিমাকল্প গড়ে তুলেছেন, যেখানে ভূমিতলে স্থিত ও আকাশচারী বিহঙ্গের সঙ্গে অন্য পশুরও সহাবস্থান রয়েছে। ভারতীয় ধ্রুপদী ঐতিহ্যের সঙ্গে দূর-প্রাচ্যের অলঙ্করণ পদ্ধতিকে তিনি সুন্দর মিলিয়েছেন। শ্রাবণী রায় সম্পূণর্ ভাবে বুননের মাধ্যমেই গড়ে তুলেছেন তাঁর নিসর্গ-ভিত্তিক অলঙ্করণময় ছবি। বুননের বুনোট ও বর্ণচয়ন তাতে বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। অর্চনা হান্ডে তাঁর নাগরিক নিসর্গ-ভিত্তিক রূপকল্পে চৈনিক চিত্রণ ও মুদ্রণ পদ্ধতির অনুষঙ্গ উন্মীলিত করেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন