চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

শ্রুতি ও দৃশ্যের মেলবন্ধন হয়ে ওঠে বর্ণময়

নন্দনে অনুষ্ঠিত ‘থার্ড আই’-এর তথ্যচিত্রটি দেখলেন মৃণাল ঘোষবইতে আমরা যা পড়ি তা শ্রুতির ভিতর দিয়ে আমাদের মর্মে প্রবেশ করে। পাঠ থেকে আমরা প্রত্যক্ষ কোনও দৃশ্যতার অভিজ্ঞতা লাভ করি না। ছবি দেখে যেমন করে থাকি। কিন্তু পড়তে পড়তে মানুষের মনে অনেক সময়ই দৃশ্য বা ছবি উৎসারিত হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share:

বাংলা গ্রন্থচিত্রণের একটি দৃষ্টান্ত

বইতে আমরা যা পড়ি তা শ্রুতির ভিতর দিয়ে আমাদের মর্মে প্রবেশ করে। পাঠ থেকে আমরা প্রত্যক্ষ কোনও দৃশ্যতার অভিজ্ঞতা লাভ করি না। ছবি দেখে যেমন করে থাকি। কিন্তু পড়তে পড়তে মানুষের মনে অনেক সময়ই দৃশ্য বা ছবি উৎসারিত হয়। তখন দৃশ্য ও শ্রব্যের সমবায়ে পাঠ্য বিষয়টি পাঠকের মনে সজীব হয়ে ওঠে। তা হলে লেখার সঙ্গে ছবির মেলবন্ধন কোন্ উদ্দেশ্য সাধন করে। নিশ্চয়ই কিছু করে। তা নইলে গ্রন্থচিত্রণ কেন বিশ্ব জুড়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি শিল্প বলে গণ্য হয়ে আসছে সুদূর অতীত থেকে। এর দুটি কারণ হতে পারে। সঙ্গীতের সঙ্গে যেমন সংগত সুরের ভিতরের ছন্দকে উন্মীলিত করে, তাকে বর্ণময় করে, তেমনই শ্রুতি-ভিত্তিক পাঠের সঙ্গে দৃশ্য-ভিত্তিক অলঙ্করণের মেলবন্ধন পাঠের ভিতর নানা অজানা মাত্রার সঞ্চার করে। পাঠ হয়ে ওঠে ছন্দোময় ও বর্ণময়। অলঙ্করণ পাঠ্য বিষয়ের অনেক অজানা দিককেও উন্মীলিত করে।

Advertisement

বাংলা গ্রন্থের অলঙ্করণ নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে আলোকচিত্র সংস্থা ‘থার্ড আই’-এর কর্ণধার অতনু পালের উদ্যোগে এবং বিশিষ্ট অলঙ্করণ শিল্পী প্রণবেশ মাইতির গবেষণায়। প্রণবেশ দীর্ঘদিন থেকে এ বিষয়ে কাজ করছেন। ২৭ মিনিট দৈর্ঘের তথ্যচিত্রটি সম্প্রতি দেখানো হল নন্দন-৩ এ। শিরোনাম: ‘ইমেজেস ভিশনারি’। ফিল্মটির চিত্রনাট্য করেছেন ধীমান দাশগুপ্ত। পরিচালনা করেছেন অর্পিতা দে। ধারাভাষ্যে ছিলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়।

এই তথ্যচিত্রে নয়টি স্বতন্ত্র দৃশ্যপর্যায়ে বর্ণিত হয়েছে বাংলা গ্রন্থচিত্রনের শৈলীগত, ভাবগত ও নান্দনিক বিবর্তনের দু’দশক ব্যাপী ইতিহাস। ‘ইমেজেস ভিশনারি’ শিরোনামটির বাংলা করা হয়েছে ‘চিত্রদীপ ভব’। অর্থাৎ চিত্র প্রদীপের মতো পাঠ্যকে আলোকিত করবে। এই বিশ্বাস নিয়ে পরিকল্পক ও পরিচালক গ্রন্থচিত্রণের বিবর্তন ও নান্দনিকতার ইতিহাসকে উন্মীলিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন।

Advertisement

১৯৭৩ সালে বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় কমলকুমার মজুমদার ‘বঙ্গীয় গ্রন্থচিত্রণ’ বিষয়ে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেটি পরে ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এই প্রবন্ধের শেষে কমলকুমার মন্তব্য করেছিলেন: ‘এখন অবস্থা এই যে বাঙালীর ছবির বইতে আঁকার তেমন নিষ্ঠা আমরা দেখি না। এখন প্রায়ই কমার্শিয়াল শিল্পীরা বই নির্মাণ করিয়া থাকেন, যাঁহাদের গ্রন্থচিত্রে সৌন্দর্য সম্পর্কে কোন জ্ঞান নাই’। অপ্রিয় হলেও কথাটির মধ্যে হয়তো কিছু সত্য আছে। এই তথ্যচিত্রে বলা হয়েছে ১৮১৬ সালে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য প্রকাশিত ‘অন্নদামঙ্গল’ গ্রন্থটিতে প্রথম ছবি ব্যবহৃত হয়েছিল। বইটিতে ছয়টি ছবি ছিল। শিল্পী ছিলেন রামচন্দ্র রায়। তার পর থেকে যত সময় এগিয়েছে, মুদ্রণশিল্পের উন্নতি হয়েছে, ততই গ্রন্থচিত্রণও পরিশীলিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ গ্রন্থচিত্রণই সাধারণ মানের ‘ইলাস্ট্রেশন’ হয় ঠিকই, কিন্তু ‘ইলিউমিনেশন’-এর পর্যায়ে উন্নীত হয় না, যাকে এই তথ্যচিত্রে ‘চিত্রদীপ’ বলা হয়েছে।

এ থেকেই বোঝা যায় সফল গ্রন্থচিত্রণ খুব সহজ কাজ নয়। এ জন্য প্রয়োজন হয় কবির প্রজ্ঞা ও শিল্পীর অন্তর্দৃর্ষ্টি। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের ‘নৈবেদ্য’-র একটি কবিতা: ‘দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টি, অতি দীর্ঘকাল, এই কবিতা নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ছবি এঁকেছিলেন। একটি বর্ণিল নিসর্গ। তাতে জলহীন শুষ্কতার আভাস আছে। সেই নিসর্গের এক প্রান্তে উপস্থাপিত একটি পাখি। দেখে বোঝা যায় সেও তৃষ্ণার্ত। এটুকু দৃশ্যতার মধ্য দিয়ে শিল্পী কবিতার প্রাণকেন্দ্রটিকে স্পর্শ করেছেন। নন্দলাল বসু’র ‘সহজ পাঠ’-এর চিত্রায়ণ বা গগনেন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’র জন্য করা ছবি অলঙ্করণের যে আদর্শকে তুলে ধরে, তার সমগোত্রীয় দৃষ্টান্ত সব সময় পাওয়া যায় না।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী থেকে শুরু করে সত্যজিৎ রায়, খালেদ চৌধুরী, পূর্ণেন্দু পত্রী পর্যন্ত যে বিবর্তন, সেই ধারায় সফল তথ্যচিত্র দর্শককে বুঝতে সাহায্য করে।

অনুষ্ঠানে দেখানে হয়েছে ‘বেনীআসহকলা’। ১১-মিনিটের এই তথ্যচিত্রে, যার চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক পূর্বোক্ত দুজনই, বর্ণের সেই রহস্যকে প্রজ্ঞাদীপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement