চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

শিল্প সাধনায় প্রকৃতির অন্তর্লীন সৌন্দর্য

সিমা-য় আয়োজিত পরেশ মাইতির একক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষপরেশ মাইতি তাঁর প্রায় তিন দশক ব্যাপী শিল্প সাধনায় প্রকৃতির অন্তর্লীন সৌন্দর্যের নিভৃত স্পন্দনটিকে অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছেন। ধীরে ধীরে সেই সৌন্দর্যই আধ্যাত্মিকতায় উন্মীলিত হয়েছে। চিত্র-ভাস্কর্যের সঙ্গে তিনি জড়িয়েছিলেন একেবারে শৈশব থেকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share:

পরেশ মাইতি তাঁর প্রায় তিন দশক ব্যাপী শিল্প সাধনায় প্রকৃতির অন্তর্লীন সৌন্দর্যের নিভৃত স্পন্দনটিকে অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছেন। ধীরে ধীরে সেই সৌন্দর্যই আধ্যাত্মিকতায় উন্মীলিত হয়েছে। চিত্র-ভাস্কর্যের সঙ্গে তিনি জড়িয়েছিলেন একেবারে শৈশব থেকে। তমলুকে তাঁর জন্ম ১৯৬৫ সালে। ওখানকার প্রকৃতির শ্যামলিমা ও জলের রহস্যময়তা তাঁকে আবিষ্ট করেছে। সেই মুগ্ধতা ক্রমান্বয়ে গভীরতর হয়ে তাঁর ভিতর যে তত্ত্ববিশ্বের উৎসারণ ঘটিয়েছে, সেটাই রূপান্তরিত হয়েছে আস্তিকতায় ধর্ম-নিরপেক্ষ সেই আস্তিকতা বা আধ্যাত্মিকতাকেই বলা যায় তাঁর সৃজনের মূল সুর।

Advertisement

পরেশ ১৯৯০ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে চিত্রকলায় স্নাতক শিক্ষা শেষ করেন। ১৯৯২-তে দিল্লির কলেজ অব আর্ট থেকে স্নাতকোত্তর করেন। তাঁকে বলা যেতে পারে ১৯৯০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পী। নব্বইয়ের দশকের শিল্পের মূল প্রবণতা ছিল তীক্ষ্ণ এক প্রতিবাদী চেতনা, বিশ্বায়ন ও উত্তর-আধুনিকতার দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় যা বিকশিত হয়েছিল। আঙ্গিকেও এসেছিল আমূল পরিবর্তন। ‘অলটারনেটিভ আর্ট’ প্রথাগত দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক শিল্প-রূপায়ণ থেকে বেরিয়ে এসে প্রকাশের ভিন্ন পথ সন্ধান করেছিল। পরেশের শিল্পের ভিতর সে অর্থে কোনও বিদ্রোহ নেই। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা নেই। যদিও ইনস্টলেশন ও ভিডিও-মাধ্যমে বেশ কিছু দিন ধরে তিনি নিরন্তর কাজ করছেন। এই বিকল্প মাধ্যমগুলির ভিতর দিয়ে তিনি মরমি আধ্যাত্মিকতারই অন্বেষণ করছেন।

সিমা-য় চলছে তাঁর ছবি, ভাস্কর্য, ইনস্টলেশন ও ভিডিও- ৭০টি কাজ নিয়ে বিপুল প্রদর্শনী। বড় আয়তনের কয়েকটি ইনস্টলেশন ও ভাস্কর্য বিড়লা অ্যাকাডেমির মুক্ত-অঙ্গনেও রাখা হয়েছে। এটি ৭৪-তম একক। প্রথম একক হয়েছিল ১৯৮৬তে। গত ২০ বছরে দেশে ও বিদেশে এতগুলি একক প্রদর্শনী তিনি করেছেন। সম্মেলকে অংশগ্রহণ তো আরও অনেক বেশি। এ থেকে তাঁর কাজের ব্যাপ্তিটা বোঝা যায়। তীব্র এক প্যাশন তাকে তাড়িত করে তাঁর সৃষ্টির দিকে। আলোচ্য প্রদর্শনী ‘সাউন্ডস অব সাইলেন্স’। ‘নৈঃশব্দ্যের ধ্বনি’।

Advertisement

যে কাজটির নাম থেকে উঠে এসেছে এই শিরোনাম, সেটি একটি প্রথাবিরোধী প্রকরণের ভাস্কর্য, যার বিষয় একটি নারী-মুখ। সেটি গড়ে তোলা হয়েছে অজস্র পিতলের ঘন্টার সমাহারে, যে ঘন্টা আমাদের দেশে গ্রামীণ জীবনের উপচার। এই স্তব্ধ ঘন্টাগুলি এক অশ্রুত ধ্বনি জাগাচ্ছে, যে ধ্বনি ঐতিহ্যের অন্তরের ধ্বনি, বিমূর্ত সঙ্গীত। এরকম অজস্র ঘন্টার সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে ইনস্টলেশনধর্মী ভাস্কর্য ‘মিস্টিক অ্যাবোড’ (বল হাউজ) – একটি চার-চালা কুটির, গেরামীণ ঐতিহ্যের অনুরণন স্তব্ধ হয়ে আছে যার ভিতর। তাঁর আধ্যাত্মিক তত্ত্ব বিশ্বের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে বিপুলকায় একটি ব্রোঞ্জ-ভাস্কর্য, দীর্ঘায়ত। একটি বিড়াল রূপায়িত হয়েছে যার মধ্য দিয়ে। এটি বিড়াল না বাঘ? এই সংশয় অবশ্য থেকে যায়। তার মুখে ধরা হয়েছে প্রস্ফুটিত একটি সূর্যমুখী। তার উত্তোলিত লেজের উপর দুটি পাখি বসে নিভৃত সংলাপ উচ্চারণ করছে। পরিব্যাপ্ত হিংসা ও সন্ত্রাসের মধ্যে এই শান্তির সন্ধানকেই বলা যায় এই শিল্পীর একান্ত জীবনদর্শন।

১৯৭৯ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে যে জলরং করেছিলেন, সেটি রয়েছে প্রদর্শনীতে ‘মধ্যাহ্ন’ শিরোনামে। ঈষৎ প্রতিচ্ছায়াবাদী, স্বাভাবিকতার অনুষঙ্গের এই জলরং পদ্ধতিকে তিনি ছাড়িয়ে এসেছেন দীর্ঘ অনুশীলনে। ১৯১২-তে করা ‘মিস্টিক’ জলরঙে যে সুনীল সাগরের রূপায়ণ রয়েছে এখানে তাতে একই তুলির টানে তিনি একাধিক পর্দার বর্ণলেপনের সৌকর্য আয়ত্ত করেছেন। শুভ্রতা ও নীলিমার দ্বান্দ্বিকতাকে ধ্যানমগ্ন সৌন্দর্যে সমন্বিত করেছেন।

এই দক্ষতা সত্ত্বেও তাঁর সামগ্রিক সিদ্ধির পরিসর তৈরি হয়েছে যখন তিনি রাজস্থানের জনজীবনের বর্ণিলতা ও বেনারসের স্থাপত্যের আধ্যাত্মিকতাকে মিলিয়ে ঘনকবাদী জ্যামিতিক বিন্যাসের আয়তনময়তাকে আত্মস্থ করলেন তাঁর রূপবিন্যাস পদ্ধতিতে। একদিকে টার্নার আর একদিকে সেজান – এই দুই মগ্নতাকে মিলিয়ে নিতে পারলেন রাজস্থানের লৌকিক উৎসারণের ছদ্মবেশে। দৃষ্টান্ত ২০১৫-তে করা ‘দ্য হ্যাপি বন্ডিং’ ও ‘এক্সপ্রেশন অব ডুয়ালিটি’। দুটি মুখের সমাহার। যে সমাহারের মধ্যে ঐতিহ্যও সমাহৃত।

জল যে তাঁর কাছে অমেয় সৌন্দর্যের বার্তা আনে তার পরিচয় আছে এখানে প্রদর্শিত চারটি ফিল্মে, যার শিরোনাম ‘জার্নি’, ‘কলকাতা’, ‘মিস্টিক মেলডি’ ও ‘ওয়াটার’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement