পুস্তক পরিচয় ২

সাধারণের জন্যই লিখতে চেয়েছিলেন

প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের অনেকেই লেখক-প্রাবন্ধিক হিসেবেও অগ্রগণ্য। বিজ্ঞান এবং সাহিত্য, দুটিই তাঁদের অনায়াস সঞ্চরণের ঊর্বর ক্ষেত্র। বিশ্বের প্রেক্ষিতে কার্ল সাগান, স্টিফেন হকিং, জর্জ গ্যামো থেকে আলবার্ট আইনস্টাইন, এরউইন স্রোডিংগার থেকে রিচার্ড ডকিন্স, জেমস ওয়াটসন, র্যাচেল কারসন— কত নাম। বাংলায় জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, রামেন্দ্রসুন্দর, গোপাল ভট্টাচার্য— উদাহরণে ঘাটতি নেই।

Advertisement

সিদ্ধার্থ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০১
Share:

প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের অনেকেই লেখক-প্রাবন্ধিক হিসেবেও অগ্রগণ্য। বিজ্ঞান এবং সাহিত্য, দুটিই তাঁদের অনায়াস সঞ্চরণের ঊর্বর ক্ষেত্র। বিশ্বের প্রেক্ষিতে কার্ল সাগান, স্টিফেন হকিং, জর্জ গ্যামো থেকে আলবার্ট আইনস্টাইন, এরউইন স্রোডিংগার থেকে রিচার্ড ডকিন্স, জেমস ওয়াটসন, র্যাচেল কারসন— কত নাম। বাংলায় জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, রামেন্দ্রসুন্দর, গোপাল ভট্টাচার্য— উদাহরণে ঘাটতি নেই। পদার্থবিজ্ঞানী (নির্দিষ্ট করে বললে কণাবিজ্ঞানী) অভীকান্তি দত্ত মজুমদারের নির্বাচিত রচনা সংকলন পড়তে পড়তে বারবারই মনে হচ্ছিল অকালমৃত অভীকান্তি (১৯৬৮-২০১৩) এই বর্ণময় তালিকায় এক উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিজ্ঞানীর প্রত্যাশিত ক্ষুরধার যুক্তি ও বিশ্লেষণ, সংস্কারের মোহমুক্ত আলোকে সব কিছুকে যাচাই করা, বুদ্ধির কষ্টিপাথরে ঘষে ঘষে পরখ করে নেওয়া এবং একমাত্র সেই মানদণ্ডেই গ্রহণ অথবা বর্জন অভীকান্তির রচনার প্রধান গুরুত্ব। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভাষার লালিত্য, স্থানবিশেষে তীব্র শ্লেষ, কঠিন তথ্য ও পরিসংখ্যানকে সাধারণ পাঠকের জন্য পরিবেশনের আপাতদুর্লভ মুন্সিয়ানা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে প্রকাশিত তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের সংখ্যা পঞ্চাশেরও বেশি। যুক্ত ছিলেন ‘সার্ন’-এ ঈশ্বরকণা ও অধঃপারমাণবিক কণা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পে। তাঁর শেষ কর্মক্ষেত্র ছিল ‘সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’। দুরারোগ্য কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় গত ডিসেম্বরে।

Advertisement

আলোচ্য সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞানীর প্রয়াণের পর। এর অনেকগুলি প্রবন্ধই আগে পত্রপত্রিকায় বা পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। মোট ১৯টির মধ্যে ৪টি প্রবন্ধ অপ্রকাশিত। প্রবন্ধগুলি মূলত তিনটি শীর্ষকে বিভক্ত। প্রথম পর্বের শীর্ষক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের রাজনীতি। প্রথম দু’টি প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্ম বিষয়ে প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত নানা তত্ত্বের ক্রমবিবর্তন। সহজ ভাষায় দুরূহ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা পাঠকদের নজর কাড়বে। দ্বিতীয় প্রবন্ধটি চমকপ্রদ: ‘বিজ্ঞানের অভিধানে কিন্তু কোনও ঈশ্বরকণা নেই’। সার্ন-এ সরাসরি ‘গড পার্টিকল’ বা ‘গড ড্যাম পার্টিকল’ বিষয়ে গবেষণারত এই কণা-বিজ্ঞানী অধঃপারমাণবিক কণার আচরণ নিয়ে চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছেন। অন্য প্রবন্ধগুলির অধিকাংশ ২০০৬-’১১ পর্বে, এই রাজ্যে দারুণ রাজনৈতিক ও সামাজিক উপপ্লবের দিনে লেখা। এখানে নিছক পদার্থবিজ্ঞানীর পরিচয় থেকে বেরিয়ে এসেছে এক সমাজবিজ্ঞানীর পরিচয়। উন্নয়ন ও উচ্ছেদ, শিল্পায়ন এবং অনাহার, নির্মাণের ঢক্কানিনাদ ও বিস্থাপনের তীব্র যন্ত্রণার চরম ঘাত-প্রতিঘাত বিজ্ঞানীর কলমে জন্ম দিয়েছে ‘কেমিক্যাল হাব: একটি নিঃশব্দ ঘাতক’, ‘হরিপুর, কোথাও পরমাণু বিদ্যুৎ নয়’, ‘সেই দিনের ফুড বাস্কেট আজকের ক্যান্সার বেল্ট’ প্রভৃতি প্রবন্ধের। এগুলি এর আগেই পুস্তিকা হিসেবে প্রচারিত হয় বহু গণসংগঠন মারফত। অভীকান্তির নেতৃত্বে গড়া একচেটিয়া আগ্রাসন-বিরোধী মঞ্চ তার মধ্যে প্রধান।

ভারতীয় কৃষি, পুরনো কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তে বিদেশি প্রযুক্তির বহুল ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক, কৃষিক্ষেত্রে বহুজাতিক-অধিজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থার ক্রমবর্ধমান প্রচ্ছায়া, কৃষকদের আত্মহত্যার মিছিল— এই সব অভীকান্তির প্রবন্ধে এসেছে বার বার। সম্পাদকরাই স্বীকার করেছেন, কিছু কথা নানা ক্ষেত্রে পুনরুল্লিখিত হয়েছে। অনেক সময়ই তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে নানা সামাজিক আন্দোলনের নেতা হয়ে ওঠা বিজ্ঞানীকে কলম ধরতে হয়েছে। বারে বারে সজোরে একই কথা বলতে হয়েছে। ফলে সে সব লেখা রচনাসংগ্রহের পাঠকের কাছে পৌনঃপুনিকতা দোষে দুষ্ট মনে হতে পারে। আসলে অভী সময়ের চাহিদা মিটিয়েছেন। ফেলে আসা উত্তাল সময়ের দিকে ফিরে তাকালে মনে হয় অভী-ই ঠিক। দুর্ভাগ্য, তিনি প্রবন্ধগুলি সংশোধনের কোনও সুযোগ পাননি। রচনা নির্বাচনের ভারও বর্তেছে অনুরাগীদের উপর। মনে হতেই পারে প্রবন্ধগুলি যত না বৈজ্ঞানিক, তার চেয়ে বেশি সামাজিক প্রচারধর্মী। আমি একমত। অভী সামাজিক প্রবন্ধই লিখতে চেয়েছিলেন সাধারণের জন্য।

Advertisement

বহু বিষয়ে অভী প্রতিবাদী। খুচরো ব্যবসায় বৃহৎ বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশকে অভী দেখেছেন দেশজ অর্থনীতির উপর একচেটিয়া সার্বিক দখলদারি হিসেবে। তাঁর কাছে এ হল নয়া উপনিবেশের সূচনা। কৃষিতে চুক্তিচাষ, বংশাণু পরিবর্তিত বা জি এম ফসলের প্রসার এবং কর্পোরেট রাজকে অভী তুলনা করেছেন নীল চাষের যুগের সঙ্গে। শপিং মল, উড়ালপুল, মাল্টিপ্লেক্স শোভিত উন্নয়নের অন্তর্বস্তু আসলে যে নূতন রূপে বহুজাতিক আগ্রাসন— এ বিষয়ে অভী নিশ্চিত। দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব প্রকৃতপক্ষে ক্ষুধার্ত ভারতবাসীর জঠরাগ্নি উপশমের জন্য নয় মনস্যান্টো, আর্চার ড্যানিয়েল মিডল্যান্ড আর ওয়ালমার্ট-এর মুনাফার স্বার্থে, তা অভী তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিমায় তুলে ধরেছেন। আধার কার্ড প্রসঙ্গে অভীর প্রবন্ধ ‘কাদম্বরী আধার বুকে লটকাইয়া প্রমাণ করিবেন তিনি ভারতীয়’— যথেষ্ট চিন্তার খোরাক জোগায়। বারবারই মনে হয় অভী সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরোধী। ‘মনোকালচার’-এর বিপ্রতীপে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, সার্বভৌমত্বের অধিকার এবং বিকশিত গণতন্ত্রের অধিকারের সমর্থক ও প্রবক্তা। বিজ্ঞানীর অভ্রংলিহ গজদন্তমিনার থেকে নেমে এসে দুঃখী দরিদ্র মানুষের সমাজে তাঁর পদচারণা।

অভীকান্তির প্রতিটি প্রবন্ধই বজ্রগর্ভ। অশেষ চিন্তা, আলোচনা এবং সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। রচনাকালের উল্লেখ থাকলে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত বুঝতে পাঠকদের সুবিধে হত। কিছু কিছু মুদ্রণপ্রমাদ এবং বানানের তারতম্য চোখে লাগে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন