TATA

শিল্পের দৃষ্টিতে ভারতের গল্প

লেখকের জন্ম ত্রিশের দশকের মধ্য ভাগে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:০৫
Share:

কুইন্টেসেনশিয়ালি টাটা: মাই জার্নি ওভার ৫৫ সামার্স
শ্যামল গুপ্ত
২৯৫.০০
রূপা

Advertisement

বইটা যখন হাতে এল, গোড়ায় গা করিনি। এক বেসরকারি সংস্থায় সুদীর্ঘ ৫৫ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন কেউ, সেই আখ্যান পড়ার তাগিদ অনুভব করিনি তেমন। তারপর, হাতের সামনে আছে বলেই উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে বুঝলাম, বইটা না পড়লে বোকামি হত। লেখক শ্যামল গুপ্ত, সম্ভবত সচেতন ভাবেই, তাঁর এই স্মৃতিকথায় বুনে দিয়েছেন স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের যাত্রাপথের কাহন। সমাজতাত্ত্বিক, রাজনীতিবিদ বা ইতিহাসের গবেষকের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, শিল্প-বাণিজ্যের অন্দরমহল থেকে। সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এই সময়কাল নিয়ে যত দিক থেকে, যত ধরনের বিশ্লেষণী পদ্ধতিতে আলোচনা হয়েছে, শিল্প-বাণিজ্যের অন্দরমহল থেকে তার কণামাত্র যে হয়নি, সে কথা অনস্বীকার্য। সেখানেই এই বইটির বিশেষ গুরুত্ব।

Advertisement

লেখকের জন্ম ত্রিশের দশকের মধ্য ভাগে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে। তাঁকে অনায়াসে নেহরু-যুগের ভারত-কল্পনার প্রতিনিধি ভাবতে পারি আমরা। প্রাক্-কৈশোরে দেশভাগ দেখেছেন তিনি, পূর্ববঙ্গ থেকে আত্মীয়েরা দলে দলে চলে এসেছেন তাঁদের কলকাতার বাড়িতে। সেই দ্বিখণ্ডিত দেশের ভবিষ্যতের ভিত্তিপ্রস্তর গাঁথার কাজে যোগ দেবেন বলে— অথবা, পারিবারিক অভিভাবকেরা সেই কাজে যোগ দিতে বললেন বলে— ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভর্তি হলেন শ্যামল। চাকরি পেলেন জামশেদপুরের টিসকো-য়। এমন একটা সময়, যখন প্রযুক্তির প্রশ্নে ভারত মূলত পশ্চিমি দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল, আর সেই কারণেই নিরন্তর চেষ্টা চলছে, কী ভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা যায়। শ্যামল গুপ্ত সেই প্রয়াসের গল্প বলেছেন নিজের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সূত্রে। ভারত-নির্মাণে এই শিল্পগোষ্ঠীর ভূমিকাও স্পষ্ট ফুটেছে।

হয়তো সময়ের ধর্মেই, লেখকের বোধ নেহরু-যুগের দর্শনে জারিত। আত্মনির্ভর হওয়ার চেষ্টা, প্রযুক্তিকেই অগ্রগতির হাতিয়ার হিসেবে মানা, বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নেওয়া ইত্যাদি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অন্যায্যতা নিয়েও। জামশেদপুরের পরিপ্রেক্ষিতে সাঁওতালদের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক— বলেছেন, এই শহর, এই কারখানা গড়ে তুলতে তাঁদের অবদান অনেক। বলেননি, যে গ্রামগুলোকে দখল করে, সেখানকার স্থানীয় মানুষদের উচ্ছেদ করে গড়ে উঠেছিল টাটানগর, ইস্পাত কারখানা, সেই জমির উপর প্রজন্মের পর প্রজন্ম হক ছিল এই সাঁওতালদের। উন্নয়নযজ্ঞ কিন্তু তাঁদের সঙ্গে নেয়নি। নেহরু-যুগের আদি ট্র্যাজেডি এখানেই— আধুনিক ভারতের মন্দির গড়ে ওঠে যাঁদের উচ্ছেদ করে, সেই বুধনিরা বড়জোর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবির এক ফ্রেমে ঢুকতে পারেন, উন্নয়নের মূল স্রোতে নয়।

নতুন দেশ গড়ার উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি কী ভাবে বাড়তে থাকে লাইসেন্স রাজ, সরকারি নিয়ন্ত্রণ, শ্যামল গুপ্তের অভিজ্ঞতায় ধরা পড়েছে সে গল্পও। ঘটনাক্রমে, সত্তরের দশকের গোড়ায় তিনি নতুন দায়িত্ব নিয়ে চলে গেলেন সিঙ্গাপুরে— সেখানে মুক্ত বাণিজ্য, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের নতুন নজির তৈরি করছেন লি কুয়ান ইউ। ফলে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের দমবন্ধ করা পরিবেশের ছবিটা ফুটে উঠেছে আরও প্রকট ভাবে। শ্যামলবাবুর আখ্যান এর পর প্রবেশ করল প্রাক্‌-উদারীকরণ রাজীব গাঁধী পর্বে— নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির শিকল ছেঁড়ার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকা দেশে। তার পরের মাইলফলক হল আর্থিক সংস্কার। ভারত সম্বন্ধে কিচ্ছুটি না-জানা বিদেশি সংস্থাকে ভারতে ডেকে আনা, তাদের কাছে ভারতীয় পণ্য বিক্রি করার চেষ্টা থেকে সব বহুজাতিকের ভারতে ঢোকার দৌড়— অর্থনীতির বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া দেখেছেন শ্যামলবাবু।

ব্যক্তিজীবনের গল্প গেঁথে গেঁথে অর্থনীতির পথচলার আখ্যান বলা, ভারতের ইতিহাস আলোচনায় একটা দরকারি কাজ করলেন শ্যামল গুপ্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন