আমি যে দুগ্গা পুজোর গন্ধ ভালবাসি তা অনেকটা আমার মায়ের গায়ের গন্ধের মতো। আমার মা আজ আর নেই। সেই পুজোর গন্ধও তেমন ভাবে আর পাই না। পুজো এখন আমার কাছে একপ্রকার ব্যবসা যা বেশ লাভজনক! বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ এই পুজো ঘিরে সারা বছরের রসদ কামিয়ে নেয়। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। দুগ্গা পুজো থেকে আমাদের সিজন শুরু হয়। অন্য সময় যে টাকা দাবি করি তার থেকে বেশি পাই এই সময়। বিদেশে-প্রবাসে ডাক আসে আর বেশ ভল মাল রোজগার হয়। জয় মা দুগ্গা!
তবে আজকে যা লিখতে বসেছি তা হল আমার ফেলে আসা পুজো নিয়ে— যেটা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত। আমার ছোটবেলা শ্যামবাজারে কেটেছে। দেশবন্ধু পার্কের অন্তর্গত লেডিস পার্কে আমাদের পুজো হত। বাবা-মার সঙ্গে হাত ধরে যেতুম, ফুচকা খেতাম, আলুকাবলি খেতাম, ঘুগনি খেতাম। ব্যস। মা তার পর হিড়হিড় করে টানতে টানতে সেই আলো ঝলমলে পার্ক থেকে আমাদের ডিপ্রেসড অন্ধকার গলিতে নিয়ে আসত। পুজো মানেই আমার কাছে ডিপ্রেশন। শরৎকাল যেই পড়ত মানে ওই সেপ্টেম্বরের মাসের মাঝামাঝি থেকেই আমার কেমন মন মুচড়ানো পেটব্যথা হত। মানে মনে অসহ্য কষ্ট আর তার সঙ্গে গ্যাসের সমস্যা। আমি একেই ডিপ্রেশন বলি। আমার খালি মনে হত আমি হেভি দুঃখী আর বাকিরা দারুণ আছে, এটা আরও বেশি দুগ্গা পুজোর সময়েই হত। পুজোয় সবাই আনন্দ করবে আর আমি শালা পায়খানায় বসে চোখের জল ফেলব। দুঃখ বিলাসিতার চরমে। মাইরি কী বলব, আমার বাবাও এমন সব কাণ্ড করতেন যা গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো হত। বাবা বোনাস পেতেন পঞ্চমীর দিন। সে দিন বিকেলে এমন সব জামাকাপড় কিনে আনতেন যেগুলো অন্তত পাঁচ বছর আগেকার ফ্যাশন। মানে ধরুন ’৮৫ সালে বাটিক প্রিন্টের চল ছিল। বাবা ’৯০-তে আমার জন্য নিয়ে এলেন যখন সবাই জিনস পরছে। এর পর যদি মন খারাপ হয়, পেটে গ্যাস হয়, তা কি অন্যায় বলুন তো? ভাললাগাও অনেক ছিল তখন, যার মধ্যে অন্যতম হল পুজোবার্ষিকী। আনন্দমেলা, শুকতারা, সন্দেশ, কিশোর ভারতী—। বাবা-মা কিনে দিতেন, আর আমি পাগলের মতো পড়তে থাকতাম। সত্যজিৎ রায় আনন্দমেলাতে কী লিখছেন তা নিয়ে উৎসাহ থাকত সবচেয়ে বেশি...এত ভাললাগা এখন কোনও কিছু নিয়েই হয় না, হলেও অনুভূতিগুলো দুগ্গা মায়ের ভোগে গেছে। পুজোবার্ষিকী ছাড়া যা আমায় টানত তা হল আমার ভাঙা মারফি রেডিয়োতে পুজোর কিছু দিন আগে বাজা অনুরোধের আসর, যাতে পুজোতে প্রকাশিত হবে এমন সব ম্যাজিকের মতো গান শোনা যেত। যেমন মান্না দে-র ‘ও চাঁদ সামলে রাখ জোছনাকে’ বা রাহুল দেব বর্মনের ‘রুবী রায়’ বা আরতি মুখোপাধ্যায়ের ‘তখন তোমার একুশ বছর’...আরও কত গান। বাবা রেকর্ড কিনতেন না, কারণ আমাদের রেকর্ড প্লেয়ার ছিল না। মনে আছে, কোনও এক অজানা কারণে কিশোর কুমারের ‘কিছু কথা ছিল চোখে’ আর ‘আমার পূজার ফুল’ এই দুটি গান শুনলেই আমার চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু হত আর কি অজানা একটা দুঃখে ভরে যেত মনটা। প্রেমে পড়িনি এখনও, প্রেম সম্বন্ধে কোনও স্বচ্ছ ধারণাও ছিল না। আসলে পেছনটা আমার অনেক দিন বেবুনের মতো-এই-আর কি...।
আমি যখন নবম শ্রেণি, বাড়ি থেকে বলা হল এ বার তুমি পুজোর দিনগুলিতে সন্ধ্যায় ঘণ্টা দুয়েকের জন্য বাগবাজারের সর্বজনীনে গিয়ে ঘুরে আসতে পারবে। একা একা বেরোবে। সে যে কি মজা কী বলব! যদিও বাবা মা জানতেন না যে সপ্তম শ্রেণি থেকে সিগারেট ধরেছি, এমনকী পাড়ার জমাদার বাবুলালের সঙ্গে বসে বাংলাও মাঝেমধ্যে খাই (ছেলে তৈরি মাল)। তো যা-ই হোক, বাগবাজার গেলাম, ঠাকুর দেখলাম, মেলা দেখলাম, মেয়েও দেখলাম প্রচুর— তার পর হাতে আধ ঘণ্টা বেঁচে। দীপু বলল, চল কুমোরটুলি! হাঁটা শুরু করে দিলাম— তার পর কুমোরটুলি থেকে মহম্মদ আলি পার্ক, এর পর কলেজ স্কোয়ার (রোজ যারা সকালে হন হন করে হাঁটেন হৃদয় ঠিক রাখতে তারা কিন্তু আমাদের থেকেই অনুপ্রাণিত)। কলেজ স্কোয়ারের ঠাকুর দেখে একটা সিগারেটের দোকানে দাঁড়িয়ে সবাই সিগারেট ধরিয়েছি। রানা বলল, দশটা বাজে, সবার মুখ ঝুপ করে কালো হয়ে গেল। হাঁটু ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করল (বেসিক্যালি ভদ্র তো!)। যাই হোক, একটা বাস ধরে ১১টায় যখন বাড়ির গলির মুখে, দেখি বাবা গলির মুখে, মা বাড়ির জানালায় খড়খড়ি খুলে ভগবানের নাম করছেন। তার পরের ঘটনা বড়ই বেদনাদায়ক। সে অন্য দিন হবে।
যখন কলেজে পড়ি তখন পুজোতে সদলবলে প্রেম করতাম এবং পুজোর পর সদলবলে সব কিছু ভুলেও যেতাম। মানে ধরুন ষষ্ঠীতে আমরা কয়েক জন আরও কয়েক জন মেয়ের সঙ্গে আলাপ করলাম। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ঘুরলাম। চোখে চোখ হল, হাতে হাত হল, যারা সাহসী তারা প্যান্ডেলের পিছনে গিয়ে চুমুও খেল। যেই দশমী এল কি ছেলেরা কি মেয়েরা একদম নিয়মমাফিক জগতে ফিরে গেল, যেন কোনও দিন তাদের আলাপ ছিল না। এই সম্পর্কগুলোর ব্যাখ্যা করা কিংবা খোঁজ বৃথা...তার থেকে বরং সেই মানুষগুলিকে কুর্নিশ জানাই।
পুজোয় আমি প্রথম রোল খাই ষষ্ঠীর দিন। লেডিস পার্কে— চিকেন রোল— তার পর থেকে রোলের প্রেমে রোলিং! আমার বন্ধুরা পুজোয় রোজগার করবে ঠিক করল, দেওয়া হল চাউমিনের স্টল। দু’দিন খাদ্যটি ঠিক চাইনিজ হয়নি, নুডলস, ডিম আর বাঁধাকপির একটা ঘ্যাঁট মতো হয়েছিল। হুজুগে বাঙালি জিন্দাবাদ, তাই গব গব করে খেল...আর রাতে সেই রোজগার দিয়ে আমাদের মহোৎসব।
যখন প্রেম করি, তখন থিয়েটারও করি। আমার প্রেমিকাও একই দলে অভিনয় করতেন। এক বছর দুগ্গা পুজোয় আমাদের বিজন থিয়েটারে পর পর শো পড়ল। প্রত্যেক দিন শো হয়। আমি ভাবি, তারপর প্রেমিকার হাত ধরে ঘুরব, ফুচকা খাব, হায় কপাল, আমাদের দলের এক গম্ভীর দাদা, যিনি আমার ইয়ের বাড়ির কাছেই থাকতেন, শো-এর শেষে ইয়েকে নিয়ে বাসে উঠে পড়তেন। আমার অসহায় ইয়ের কিছু করারও ছিল না...আর আমি ওই গোমড়ামুখো আঁতেল দাদাটিকে মহিষাসুর বলে ভাবতাম।
এর পর পুজোর অন্য মানে এসে গেল। সে মানে এখনও চালু রয়েছে। পুজো মানেই আমার পুজোর গান। কোন লেবেল করবে, কে করবে না, কত রয়্যালটি, ফিজিক্যাল এবং ডিজিটাল অধিকার...ভ্যানতারামি প্রচুর। পুজোর গান গেয়ে জনপ্রিয়তা এল,...পুজোর দিনগুলোয় মুজরা আসতে লাগল, দেশে, প্রবাসে মায় বিদেশেও। গত ১১ বছর তো আমি পশ্চিমবাংলার পুজোই দেখিনি। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই এমন দুগ্গা পুজোয় আমি, আমার বৌ, বাচ্চা খুব ভাল থাকে...জয় মা দুগ্গা!