রেলিং ভাঙা সেতু। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
ভরা বর্ষায় নবদ্বীপের গৌরাঙ্গ সেতুর পায়ের কাছে নৌকা থেকে পাইপ নামিয়ে তোলা হচ্ছে বালি। একেবারে দিনে-দুপুরেই।
সোমবারই ধরা পড়েছে গভীর পাইপ লাগানো ড্রেজার বসানো নৌকা। চোরেরা অবশ্য বেপাত্তা!
মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়ার পরে সব সেতু ঘিরেই নজরদারি বেড়েছে। তবে যে ভাবে সেতুর কাছ থেকে এত দিন ধরে অবাধে বালি চুরি হয়েছে, তাতে স্তম্ভের গোড়া দুর্বল হয়ে যায়নি তো? আশঙ্কা বাড়িয়েছেন পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশ। তাঁদের মতে, এতে অনেকটাই ক্ষতি হয়েছে সেতুর।
কী ভাবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনও সেতুর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল তার দু’ধারের স্তম্ভ। যদি নদীপাড়ের জমি কোনও ভাবে আলগা হতে শুরু করে, স্তম্ভের ভিত দুর্বল হয়ে যেতে পারে। পাড়ের কাছে নদীগর্ভ থেকে যথেচ্ছ বালি তোলা হলে সেখানে একটা ফাঁক তৈরি হয়। তা ভরাট করতে পাড়ের বালি গড়িয়ে নেমে আসে। ফলে পাড়ে সেতুর প্রধান স্তম্ভের কাছে জমির বুনোট আলগা হতে থাকে।
প্রশাসনের কর্তারা দাবি করছেন, বালি চুরি রুখতে তাঁরা অহোরাত্র সতর্ক আছেন। মহকুমাশাসক (সদর) অম্লান তালুকদার বলেন, ‘‘মঙ্গলবারই পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সেতুর আশপাশ থেকে কোনও ভাবেই যাতে বালি তোলা না যায়, তার জন্য সিসি ক্যামেরা বসানো হচ্ছে।’’ নদীপারের হাজার-হাজার চোখ কিন্তু বলছে, খালি চোখেই চোরদের দিব্যি দেখা যায়। কিন্তু তারা এতটাই প্রভাবশালী যে পুলিশও তাদের সমীহ করে চলে বলে অভিযোগ।
সাদা চোখে দেখলে কিন্তু গৌরাঙ্গ সেতুর হাল ভালই। ভার বহনের দিক থেকে ‘ক্লাস-এ’ পর্যায়ের। ১৯৭২ সালে তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী, কংগ্রেসের ভোলা সেনের হাতে এই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। ১৯৮৩-র ১৬ জানুয়ারি বামফ্রন্ট সরকারের পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী সেটির উদ্বোধন হয়। উল্টো পারে নবদ্বীপের গ্রামাঞ্চল ছুঁয়ে রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে বর্ধমানের কালনা শহরের দিকে। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে এই সেতুর গুরুত্ব যথেষ্ট। এখন দিনে গড়ে অন্তত পনেরো হাজার গাড়ি চলে। তার মধ্যে ভারী গাড়ির সংখ্যা ২২০০ থেকে ২৭০০। আগে যেখানে ২০ টনের লরি যেত, এখন সেখানে ৪০-৫০ টন মাল নিয়ে বিশ চাকার ট্রেলার যাচ্ছে অহরহ। ঈশ্বর গুপ্ত সেতু দিয়ে ভারী গাড়ি চলাচল বন্ধ হওয়ায় চাপ আরও বেড়েছে।
গৌরাঙ্গ সেতু যে সময়ে গড়া, সেই সময়ের আধুনিকতম প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছিল এতে। সেতু নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত পূর্ত দফতরের অবসরপ্রাপ্ত এক প্রবীণ ইঞ্জিনিয়ার জানান, নবদ্বীপ ভাঙনপ্রবণ এলাকা হওয়ায় ব্যবহার করা হয়েছিল ‘বোর পাইলিং’ পদ্ধতি। সেতুর দু’ধারের প্রধান স্তম্ভ মাটির বহু নীচ পর্যন্ত নামিয়ে কংক্রিট দিয়ে জমানো রয়েছে। তা ছাড়া, এটি ‘হলো স্ফিয়ার ব্রিজ’ অর্থাৎ সেতুর দুই প্রান্তে ফাঁপা জায়গা আছে। স্তম্ভ বা গার্ডারে কোনও সমস্যা হলে সেই জায়গা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার বা নির্মাণকর্মীরা মেরামতির জন্য নামতে পারেন।
এত কিছুর পরেও কিন্তু বছর তিনেক আগেই নবদ্বীপের প্রান্তে সেতুর গার্ডার বসে গিয়েছিল। ২০১৬ সালে বড়সড় সংস্কার করা হয়। সেতুর উপরিতল নতুন করে গড়া হয়। বেয়ারিং বদলানো হয়। এর জন্য কিছু দিন বন্ধও রাখা হয় সেতু। গত বছর মুর্শিদাবাদে বাস বিলে পড়ে যাওয়ার পরে গার্ডওয়াল বসানোর কাজও হয়ে গিয়েছে। যদিও তার মধ্যেই খসে গিয়েছে খানিকটা রেলিং। এখনও বাঁশের বেড়া দিয়ে সেই জায়গা আগলানো আছে।
কিন্তু এ সব তো গেল উপরের গল্প। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারদের মতে, বালি চুরি বন্ধ না করলে সেতু বাঁচানো যাবে না। গোড়ার সেই গলদ কি আদৌ দূর করা যাবে?
(সহ প্রতিবেদন: সুস্মিত হালদার)