জাকিরুন আপা ছুটছেন। পথেই একটার পর একটা ফোন। ‘সোর্স’ জানাচ্ছে, হাতে বেশি সময় নেই। রেজিস্ট্রার, মৌলবি চলে এসেছেন। ‘কবুল’ বলাটা সেরেফ সময়ের অপেক্ষা। বিশ্বস্ত যোদ্ধা উত্তেজনায় ফুটছে, ‘আপা, আমরা তৈরি। তুমি নির্দেশ দিলেই বাড়িতে ঢুকে যাব।’ অচেনা নম্বর শাসাচ্ছে, ‘বাড়ি ফিরে যান। বড্ড বাড়াবাড়ি করছেন। এর ফল কিন্তু ভাল হবে না।’
ও-প্রান্তের কথা শেষ না হতেই জাকিরুন বড় অবজ্ঞার সঙ্গে চাপ দেন ফোনের লাল বোতামে। তাঁর চোখের সামনে তখন ভাসছে, বছর এগারো-বারোর একটি মেয়ের মুখ। কনের পোশাক পরে সে কাঁদছে। আর মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে বাড়ির সদর দরজার দিকে।
ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁইছুঁই। সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছতেই হবে। দেরি হলেই সর্বনাশ! অন্ধকারে মেঠো পথ ভেঙে আপা হাঁটছেন। পিছনে পুলিশ।
বিয়েবাড়িতে কন্যাশ্রী যোদ্ধাদের নিয়ে জাকিরুন পা রাখতেই অন্ধকার খেতে মিলিয়ে গেলেন পাত্র, বরযাত্রী, রেজিস্ট্রার, মৌলবি। বাড়ির লোকজনও মুহূর্তে গায়েব। কেবল এগারো বছরের মেয়েটি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল জাকিরুনকে, ‘‘জানতাম আপা, তুমি আসবে।’’ বিয়ে ভাঙার কাহিনিও এমন মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়!
নাবালিকার বাবা প্রশাসনের কাছে মুচলেকা দিলেন, মেয়ে সাবালিকা না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দেবেন না। মা কবুল করলেন, ‘‘মেয়ের কথা না শুনে বড্ড ভুল করছিলাম।’’ জাকিরুন বাড়ির সকলকে তখনও বুঝিয়ে চলেছেন, কী ভয়ংকর ভুল তাঁরা করতে চলেছিলেন। ফের বাজছে জাকিরুনের ফোন। এ নম্বর তাঁর চেনা। কিন্তু জাকিরুন সে ফোন ধরতে পারছেন না।
এ দিকে, সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা হাজির। তাঁদের আবদারেই নাবালিকা ও কন্যাশ্রী যোদ্ধাদের সঙ্গে ছবি তুলতে হল। যোদ্ধাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে জাকিরুন নিজের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। রাত তখন বারোটা! জাকিরুনের ফোনে বাড়ির কর্তার অন্তত গোটা বিশেক ‘মিসড কল’! কড়া নেড়ে সাড়া মেলে না। বেজে যায় কর্তার ফোনও। জাকিরুন তৈরি হন আরও একটি ঠান্ডা লড়াইয়ের জন্য। পৌষের রাতে বাড়ির বাইরে দীর্ঘ অপেক্ষার পরে দরজা খোলেন জাকিরুনের স্বামী, ইলিয়াস মণ্ডল। ক্লান্ত, শ্রান্ত জাকিরুন স্বামীকে বুঝিয়ে বলেন, ‘‘ফোনটা ধরা উচিত ছিল। এমনটা আর হবে না।’’
ইলিয়াস বলছেন, ‘‘সত্যিই খুব রাগ হয়েছিল। ‘আসছি’ বলে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল। এ দিকে রাত বাড়ছে, জাকিরুনের পাত্তা নেই। ফোন করছি। ধরছে না। ও যা করছে, তাতে চার পাশে শত্রু তো বেড়েই চলেছে। আজকাল বড় ভয় হয়, জানেন।’’
এখন জাকিরুনকে সকলেই চেনে নাবালিকার বিয়ে রোখার অন্যতম সেনাপতি হিসেবে। কিন্তু মেয়েদের জন্য লড়াই শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। জাকিরুনের বাবার ছিল সাইকেল সারাইয়ের দোকান, আর বিড়ির কারবার। মা, বাবা, সাত বোন আর দুই ভাই নিয়ে বড় সংসার। স্কুলবেলাতেই জাকিরুন শিখে নিয়েছিলেন বিড়ি বাঁধা। বাবার কাছে সাইকেল সারানোর কাজও। জাকিরুনের নিজেরও বিয়ে হয় ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়। ইলিয়াস তখন টুয়েলভে। কিন্তু আর পাঁচটা নাবালিকার মতো অভিশপ্ত জীবন কাটাতে হয়নি জাকিরুনকে। ইলিয়াস হাসছেন, ‘‘আসলে বিয়ে হয়েছিল নামেই। স্বামী-স্ত্রীর মতো আমরা থাকার অধিকার পাই জাকিরুনের আঠারো বছর পূর্ণ হওয়ার পরে।’’
আজ থেকে বছর দশেক আগেও মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার চেহারা ছিল অন্য রকম। সাধারণ পরিবারের মেয়েরা বাড়ির বাইরে গিয়ে কিছু করবে, ভাবতে পারতেন না অনেকেই। অথচ জাকিরুন সেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন। বুঝেছিলেন, সারাজীবন অন্দরমহলে থেকে গেরস্থালির কাজ আর সন্তান প্রসব করাটাই মেয়েদের জীবন হতে পারে না। নিজে যেমন সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিলেন, সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন আরও কয়েক জনকে।
তার পরে তৈরি করলেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। ২০১১ সালে এলাকার মেয়েদের নিয়ে একশো দিনের কাজে দু’লক্ষ চারা পুঁতলেন। গোটা এলাকা জুড়ে তখন গেল গেল রব। জাকিরুন বলছেন, ‘‘সেই সময়টা আরও কঠিন ছিল। কাজ করতে অসুবিধা হত বলে বোরখা খুলে একশো দিনের কাজ করতাম। এলাকার লোকজন তখন শ্বশুরকে এসে নালিশ জানাল, আপনার বউমা বাড়ির মহিলাদের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। লোকজনের সে কী রাগ! শ্বশুর কিন্তু সে দিনও আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন।’’
শ্বশুর মকিবুর রহমান মণ্ডল ও শাশুড়ি খাইরুন্নেসা বিবিকে নিজের ‘মেন্টর’ বলে মানেন জাকিরুন। এখনও। জাকিরুন বলছেন, ‘‘আমি ওঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। বিয়ের পরে আমি বিএ পাশ করেছি। সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আর এ সব বাড়িতে বসে হয়নি। কত লোক কত কথা বলেছে। কিন্তু আমার শ্বশুরবাড়ি কখনও বাধা দেয়নি। এখন আলাদা বাড়িতে থাকলেও রাতের খাবারটা শাশুড়ির কাছেই খাই।’’
(চলবে)