দুনিয়াটি যে অনিশ্চিত, সন্দেহ নাই। কিন্তু, দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ঘাড় ধরিয়া সেই অনিশ্চয়তার স্বাদ চাখাইয়া দেওয়া হইলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিবে, শিক্ষাব্যবস্থার হাল ঠিক কাহাদের হাতে ছাড়িয়া রাখা হইয়াছে। প্রকাশ জাবড়েকর বলিয়া দিয়াছেন, তাঁহার দায় নাই। অতএব, অভিযোগের তর্জনীটি সিবিএসই-র কর্তাদের দিকেই নির্দেশ করিতেছে। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরিয়া কেন্দ্রীয় বোর্ড ‘মডারেশন’-এর একটি নীতি অনুসরণ করিত। নীতিটি খানিক বিচিত্র সন্দেহ নাই— কোনও প্রশ্ন কঠিন হইলে, অথবা অন্যান্য বৎসরের তুলনায় কোনও একটি নির্দিষ্ট বৎসরে কোনও অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের ফল খারাপ হইলে বোর্ড কিছু বাড়তি নম্বর দিত। ফুচকাওয়ালাদের তুলনায় ফাউয়ের পরিমাণ বেশি— প্রাপ্ত নম্বরের ১৫ শতাংশ অবধি বাড়তি মিলিত। গত কয়েক বছরে যে তুমুল নম্বর-স্ফীতি ঘটিয়াছে, যাহার দৌলতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কলেজে কিছু বিষয়ের ‘কাট অফ’ নম্বর ১০০ শতাংশে ঠেকিয়াছে, তাহা এই মডারেশন নীতিরই ফল। সিবিএসই-র দেখাদেখি আরও বহু বোর্ড ঘোষিত ভাবে অথবা ঘোষণা না করিয়াই নম্বর-স্ফীতির এই নীতিটি মানিতে আরম্ভ করে। গত বৎসর সিবিএসই-র কর্তাদের আচমকা খেয়াল হয়, মডারেশনের নীতিটিকে ছাঁটিয়া ফেলিতে হইবে। তাঁহারা ভাবনাটিকে কাজে পরিণত করিলেন, তবে এই বৎসরের পরীক্ষা হইয়া যাইবার পর। এইখানেই অনিশ্চয়তা। ছাত্রছাত্রীরা জানিল না, ঠিক কী ভাবে তাঁহাদের খাতার মূল্যায়ন হইবে। জানিল না, অন্যান্য বোর্ডও মডারেশন বন্ধ করিবে কি না। জানিল না, অন্য বোর্ডের তুলনায় তাহাদের নম্বর কমিয়া গেলে কলেজে ভর্তি হইবার কী ব্যবস্থা হইবে। এই অহেতুক অনিশ্চয়তা যাঁহারা তৈরি করিতে পারেন, তাঁহারাই দেশের স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
একেবারে শেষ মুহূর্তে, দিল্লি হাইকোর্টের ধমক খাইয়া সিবিএসই ফের সিদ্ধান্ত বদলাইল। সাত দিন আগেও জানা ছিল, মডারেশন হইবে না— ফলাফল প্রস্তুত, কিন্তু আদালতে মামলা চলায় প্রকাশ স্থগিত আছে। সাত দিন পর পরীক্ষার ফল প্রকাশ করিয়া বোর্ড জানাইল, মডারেশন হইয়াছে। মাত্র পাঁচ-সাত দিনে গোটা দেশ জুড়িয়া হওয়া একটি পরীক্ষার ফলাফলের মডারেশন সম্ভব? মডারেশন পদ্ধতিটি সমতাবিধানের যে নীতি অনুসরণ করে, তাহা যদিও বা যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য না হয়, তবুও তাহার নিজস্ব প্রক্রিয়া রহিয়াছে। মডারেশন যদি করিতেই হয়, তবে সেই প্রক্রিয়ার দাবি মানিয়া করাই বিধেয়। এক সপ্তাহে তাহা সম্ভব, এমন দাবি সম্ভবত কেহ করিবেন না। ঠিক কী হইল, গড়ে নম্বর বসাইয়া দেওয়া হইল কি না, যাহাতে কোনও আপত্তি না উঠে তাহা নিশ্চিত করিতে প্রত্যেককেই তুলনায় বেশি নম্বর দেওয়া হইল কি না, কোনও প্রশ্নেরই উত্তর নাই। আছে শুধু এক ব্যাপক ও সুগভীর অস্বচ্ছতা। তাহার দায় পরীক্ষার্থীদের নহে তো বটেই, আদালতেরও নহে। দায় সম্পূর্ণত বোর্ডের। বৃহত্তর অর্থে, কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের। মন্ত্রিবর যতই দায় ঝাড়িয়া ফেলিতে চেষ্টা করুন, এই অস্বচ্ছতার জন্য জবাবদিহির নৈতিক দায়িত্ব তাঁহারও। এমন বিপুল তাৎপর্যপূর্ণ একটি সিদ্ধান্তকে যাঁহারা ছেলেখেলায় পর্যবসিত করিতে পারেন, শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক হইবার কিছুমাত্র যোগ্যতা কি তাঁহাদের আছে?