উজ়বেকিস্তানের নাম এলেই বাঙালিরা বলে, আরে, ‘উজবুক’-এর দেশ আবার যাওয়ার জায়গা হল নাকি! এই মনোভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করেই উজ়বেকিস্তান রওনা হলাম আমরা, হাফিজ়ের কাব্যে পড়া দু’টি শহরের নাম ভাবতে ভাবতে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে সেই বিখ্যাত প্রেমবচন, ‘‘গালে কালো তিল সেই সুন্দরী, স্বহস্তে ছুঁলে হৃদয় আমার/ বুখারা তো ছার, সমরখন্দও খুশি হয়ে তাকে দেব উপহার।’’ তা ছাড়া ইতিহাসে পড়েছি তাসখন্দ চুক্তির কথা। লেখক-সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের লেখা ‘পেশোয়ার থেকে তাসখন্দ’ (১৯৬৬) ভ্রমণবইয়ে পড়েছি তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর বিয়োগের কথা। প্রধানমন্ত্রীর নিমন্ত্রণ থেকে ফিরেই শাস্ত্রী বুকে ব্যথা বোধ করেন। হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় কিছু পরই। ‘‘আনন্দনগরী তাসখন্দকে শাস্ত্রীর মৃত্যু শোকের নগরীতে রূপান্তরিত করল। সর্বত্র শোকের ছায়া।’’
উজ়বেকিস্তানে গিয়ে শুনলাম শাস্ত্রীর নামে এই শহরে একটি সড়ক রয়েছে। ইতিহাসপ্রিয়তার ছোঁয়া তাসখন্দ-সহ গোটা দেশে বিস্তৃত। সিল্করুটের ইতিহাসঋদ্ধ মধ্য এশিয়ার এই দেশটি যেন আমির তিমুর অর্থাৎ হ্যারল্ড ল্যাম্বের ‘দিগ্বিজয়ী তৈমুর’ বন্দনায় ব্যস্ত। তাকে নিয়ে বহির্বিশ্বে আর ইতিহাসের নিরপেক্ষ পাতায় যা-ই লেখা থাকুক না কেন, বর্তমান উজ়বেক জাতি যেন তার মহিমা কীর্তনে রাষ্ট্রীয় ভাবে পণবদ্ধ। অবশ্য তার ইহজাগতিক পৌত্র উলুক বেগের ভাস্কর্যও চোখে পড়ে, তার সঙ্গে তৈমুরের মিলের কারণে কোন জন দাদু আর কোন জন নাতি, এ নিয়ে বিভ্রান্তিতেও ভোগেন অনেকে। দু’জনার ফারাকও বেশ। এক জনের জগৎজয়ের নেশা। অন্য জনের আগ্রহ জ্যোতির্বিজ্ঞান, সূর্যঘড়ি, মানমন্দির, ত্রিকোণমিতিতে।
রসস্রষ্টা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা-সহ সমস্ত জাতীয় গৌরববাহকদের বিচিত্র সব ধাতব ভাস্কর্য দেখে বিস্মিত হয়ে ভাবছিলাম, ভাস্কর্যবিরোধী রক্ষণশীলদের তোয়াক্কা না করে মুসলিমপ্রধান উজ়বেক দেশের ঐতিহ্যচর্চার কী অদ্ভুত ধারা। বোখারাতে আমাদের হোটেলের সামনের পার্কটাই দেখলাম হোজ্জার ভাস্কর্যসূত্রে ইউনেস্কোর বিশ্বঐতিহ্য তালিকাভুক্ত এলাকা। এমন ঐতিহ্য ছড়ানো-ছিটানো পথে-প্রান্তরে। পাশাপাশি প্রাচীন মসজিদ, মাদ্রাসা, গির্জা। জাদুঘর, ক্যারাভান, সরাই, ইহুদিপাড়া, সব মিলেমিশে উদারতার আবহে বাঁধা বোখারার মতো উজ়বেক শহরগুলো। ধর্মীয় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় প্রতিটিতে। ইমাম বোখারি-সহ ধর্মীয় শ্রদ্ধেয়জনদের মাজারে পূর্ণ দেশটি। কিন্তু কোথাও মাজার ঘিরে উৎকট কিছু চোখে পড়ে না।
খিভা নগরীতে যেমন প্রচুর পাশ্চাত্য পর্যটকের ভিড়। তেমনই আবার দেখলাম, নানা দেশের মুসলিম তীর্থযাত্রীর দল জটলা পাকায় সমরখন্দ, বোখারায়। তবে আমরা সেখানেও খুঁজে ফিরি শিল্পসাহিত্যের সুলুক; পেয়েও যাই। খিভা থেকে সড়কপথে বোখারা যাওয়ার পথে পড়ে ঐতিহাসিক খিজিলখুম মরুভূমি, আমুদরিয়া, শিরদরিয়া। মুহূর্তেই মনে আসে কবি আলিশের নওয়ারির কথা, তাঁর লাইলি মজনু-শিরি ফরহাদ উপাখ্যানের অঞ্চল তো এটাই। মিহি রোদ্দুর আর হাওয়ার দুপুর যেন তাদের প্রেমের কুঁড়ি মেলে ধরে। বোখারায় ঐতিহাসিক কালান মিনার (এক সময় সুউচ্চ এই মিনার থেকে আমিরেরা অপরাধীদের নীচে ছুড়ে ফেলতেন বলে এ মিনার ‘মৃত্যুমিনার’ নামেও পরিচিত)। যদিও এটি বোখারায় তবু উজ়বেক শহরের এই মিনার দেখেই মনে পড়ল ভূপেন হাজরিকার গানের পঙ্ক্তি ‘‘গালিবের শের তাসখন্দের মিনারে বসে শুনেছি।’’
সমরখন্দের রেগিস্তান স্কোয়ারে কিছু দিন আগেই হয়ে গেল ‘হইচই আনলিমিটেড’-এর শুটিং। বাংলা ছবির এই উজ়বেক ভ্রমণ কেবল শুটিং স্পট হিসেবেই নয়, যৌথ প্রযোজনা এবং ভাষারও। উজ়বেকিস্তান-সহ মধ্য এশিয়ার চারটি দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মসয়ুদ মান্নান জানালেন চলচ্চিত্র, নাটকের মানুষজন-সহ উপমহাদেশের অনেকেই এখন ঘুরতে আসেন এই অসাধারণ নিসর্গ ও ইতিহাসের দেশে। সমরখন্দে আমাদের গাইড শাহরুখ নামে এক যুবক। আমরা সমস্বরে ‘শাহরুখ খান’ বলে তাঁকে স্বাগত জানালাম। বিদায় নেওয়ার সময় স্মিত হেসে তিনি যখন বললেন, ‘‘বিদায়, কাজলের সঙ্গে দেখা হলে বোলো শাহরুখের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সমরখন্দে’’ তখন বোঝা গেল চলচ্চিত্রের চরিত্র কতটা শক্তিশালী; মুম্বই থেকে তা অবলীলায় চলে আসে মধ্য এশিয়ায়।
বোখারার শীতপ্রাসাদ দেখতে গেলাম। একদা এখানেই বন্দি ছিলেন তাজিক কবি সদরুদ্দিন আইনি, যিনি ‘সেকালের বোখারা’ নামে রচনা করেছিলেন এক মনোহর গ্রন্থ; রুশ থেকে তা বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। সোভিয়েট সমাজতন্ত্র উজ়বেকিস্তানের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যে যোগ করেছিল নতুন মাত্রা। সোভিয়েট ভেঙেছে তিন দশকও হয়নি, অথচ সোভিয়েট কতটা খারাপ ছিল সে প্রশিক্ষণ মনে হয় সমস্ত গাইড ও টুর অপারেটরকে বাধ্যতামূলক ভাবে দিয়ে রেখেছেন উজ়বেক কর্তৃপক্ষ!
আমাদের গাইড আবদুল্লাহ যেমন সংস্কারমুক্ত, বুদ্ধবাদে আগ্রহী, তেমনই সোভিয়েট বিরোধিতায় ব্যাপক উৎসাহী। কেবল ভ্রমণের শেষ ভাগে তাসখন্দ থেকে দূরে বরফগলা পাহাড়ি এলাকায় রোপওয়েতে অনেকেই যখন উঠতে ভয় পাচ্ছে, তখন তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘‘ভয় পেয়ো না, এটা সোভিয়েট আমলের তৈরি। সোভিয়েট আমলে তৈরি সব কিছুই মজবুত ও নির্ভেজাল।’’ চাপিয়ে দেওয়া রুশীকরণ আর ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ব্যতীত বৈষম্যমুক্ত সমাজ-সহ অনেক কিছুই সোভিয়েট দিয়েছিল তাদের। বিশেষত বহু বিশ্ব সম্মেলন ঘটিয়ে তাসখন্দ পেয়েছিল আন্তর্জাতিক পরিচিতি। তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। সে সময়ে পাওয়া নারীস্বাধীনতার পরিচয় কেবল এখানকার নৃত্যের ছন্দেই নয়, ধর্মীয় ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে দোকানবাজার রাস্তায় মেয়েদের অবাধ চলাফেরাতেও। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে এ শহরে বাস করেছেন তলস্তয়, সের্গেই এসেনিন, আন্না আখমাতোভা। পাতাঝরা মায়াবী এলাকায় লিয়ো তলস্তয়ের তাসখন্দ অবস্থানকালীন ভবনটি। তাসখন্দের ইউরোপীয় বাজারের পথে পথে বিক্রি হতে দেখলাম মার্ক্স, এঙ্গেলস, স্ট্যালিন, লেনিনের ছবি। বিপ্লব বসত করে সড়কে, বাস্তবে না হলেও, মনের মাটিতে।
দূরত্বের কারণে যাওয়া হল না ফারগানা। দেখা হল না মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের জন্ম ও সমাধিভূমি। ফেরার পথে এক উজ়বেক তরুণের সঙ্গে দেখা। চলচ্চিত্র বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করতে সে দিল্লির নয়ডায় চলেছে। ভাবছিলাম, জগৎজয়ের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে বইকি। একদা বাবর এই দেশ থেকে সাম্রাজ্যের বিস্তারে রওনা হয়েছিলেন ভারতের দিল্লিতে। আজ উজ়বেক তরুণ দিল্লি চলেছে এক ভিন্ন শিল্পের সম্মোহনে।