অচ্ছে দিন তবে অধরা রহিল পঁচিশ লক্ষ মানুষের কাছে। তাঁহারা স্কুলের মধ্যাহ্নভোজনের রন্ধনে নিযুক্ত। নরেন্দ্র মোদী সরকারের কার্যকাল শেষ হইল, নির্বাচন বিধি জারি হইয়া গেল, তাহাদের বেতন বাড়িবার আশাও ফুরাইল। এক-দেড় শত পড়ুয়ার জন্য ভাত-ডাল-তরকারি রাঁধিবার কাজটি সামান্য নহে। শিশুদের পুষ্টিকর আহার দিবার গুরুত্বও স্বীকৃতি পাইয়াছে। কিন্তু রন্ধনকর্মীরা আজও ‘কর্মী’ বলিয়া স্বীকৃতি পান নাই, কেন্দ্রের মতে তাঁহারা ‘স্বেচ্ছাসেবী’। বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া, সপ্তাহে পাঁচ দিন, পাঁচ ঘণ্টা করিয়া পরিশ্রমকে ‘স্বেচ্ছাশ্রম’ আখ্যা দেওয়া নিষ্ঠুর রসিকতা। দেশের দরিদ্রতম মহিলাদের সহিত কেন্দ্র দশ বৎসর ধরিয়া এই প্রহসন করিয়া চলিয়াছে, কারণ স্বেচ্ছাসেবীকে ‘সাম্মানিক’ দিলেই যথেষ্ট। ‘শ্রমিক’ বলিয়া স্বীকৃতি দিলেই ন্যূনতম পারিশ্রমিক দিবার দায় ঘাড়ে চাপিবে। তাই দশ বৎসর ধরিয়া পারিশ্রমিক বাড়ে নাই মিড ডে মিল কর্মীদের। তাঁহারা এক এক জন এখনও মাসে হাজার টাকার বিনিময়ে কাজ করিয়া চলিয়াছেন। যাহার অর্থ, তাঁহাদের রোজগার দিনে এক শত টাকাও নহে, চল্লিশ টাকা হইতে পঞ্চাশ টাকা। অধিকাংশ রাজ্যে দৈনিক ন্যূনতম মজুরি অন্তত দুই শত টাকা। বহু বৎসর ধরিয়া ন্যূনতম বেতনের জন্য, এবং বিভিন্ন সরকারি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সুবিধার জন্য দরবার করিতেছেন এই কর্মীরা। তাঁহাদের এই দাবিকে সমর্থন করিয়াছে সব কয়টি জাতীয় শ্রমিক সংগঠন। পর পর চার বার জাতীয় শ্রম সম্মেলন সরকারি প্রকল্পে নিযুক্ত কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি দিবার দাবি সরকার উপেক্ষা করিয়াছে।
যুক্তি যখন ব্যর্থ হইয়া যায়, মানবমন তখন কল্পনার আশ্রয় লইতে চাহে। বুদ্ধি দিয়া স্কুলে যাহা বুঝিতে ব্যর্থ হইয়াছেন মন্ত্রীরা, নিজ হস্তে কাজ করিলে কি তাহা বুঝিতেন? তাঁহারা যদি এক দিন স্বেচ্ছাশ্রম দিতেন, না জানি কেমন হইত। বনের কাঠ কুড়াইয়া আনিতেন, কয়লা ভাঙিয়া উনুন ধরাইতেন, টিউবওয়েল টিপিয়া জল তুলিতেন। বাসন ধুইতে কত শক্তি ব্যয় হয়, কতটা সময় লাগে ডাল-সব্জি বাজার করিতে, রন্ধন-পরিবেশনের পরেও ভোজনস্থল পরিষ্কার করিতে, তাহা বুঝিয়াও দিনে চল্লিশ টাকা হাতে ধরাইতে পারিতেন? মহাত্মা গাঁধী কায়িক শ্রমের প্রতি উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তের তাচ্ছিল্য বুঝিতেন বলিয়াই নিজ হস্তে গৃহস্থালির কাজ করিতেন। বিদ্যালয়ে এক দিন স্বেচ্ছাশ্রম দিলে নেতাদের চোখে পড়িত সেই মহিলাদের, যাঁহারা শিশুদের পুষ্টিবিধান করিতে নিযুক্ত। অপুষ্টি-শীর্ণ, শ্রমক্লান্ত দেহগুলি নিজ চক্ষে দেখিয়াও কি মন্ত্রী-সাংসদরা ওই মেয়েদের ‘স্বেচ্ছাসেবী’ বলিবার ধৃষ্টতা করিতে পারিতেন?
হয়তো পারিতেন, নেতাদের অসাধ্য কিছুই নাই। যদিও লোকসভায় অষ্টাশি শতাংশ এবং রাজ্যসভায় নব্বই শতাংশ সাংসদ কোটিপতি, তবু অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি গত বৎসরই সাংসদদের মাসিক বেতন দ্বিগুণ করিয়াছেন। তিনিই পাঁচ বৎসরে রন্ধনকর্মীদের পারিশ্রমিক বাড়াইবার কারণ খুঁজিয়া পান নাই। মিড ডে মিল কর্মীরা শ্রমের মূল্য বুঝাইতে কয়েক বার ধর্মঘট করিয়াছেন। কিন্তু শিশুদের প্রতি দায়বদ্ধতা হইতে তাঁহারা সাধারণত কাজ এড়াইতে চান না। এই দলিত-আদিবাসী মহিলা শ্রমিকদের জন্য ঘণ্টায় দশ টাকা ‘সাম্মানিক’ই যথেষ্ট সাব্যস্ত করিয়া দেশকেই অসম্মানিত করিল মোদী সরকার। নিজেদেরও।