সম্পাদকীয় ২

হিংস্র শাসন

পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্কৃতিতে গণপিটুনির একটি ধারা ছিলই। চোর, পকেটমার ইত্যাদি সন্দেহে কেহ জনতার হাতে ধরা পড়িলে পুলিশ ডাকিবার পূর্বে তাহাকে একপ্রস্ত উত্তমমধ্যম দিবার উদাহরণ অজস্র আছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্কৃতিতে গণপিটুনির একটি ধারা ছিলই। চোর, পকেটমার ইত্যাদি সন্দেহে কেহ জনতার হাতে ধরা পড়িলে পুলিশ ডাকিবার পূর্বে তাহাকে একপ্রস্ত উত্তমমধ্যম দিবার উদাহরণ অজস্র আছে। নিঃসন্দেহে ইহা অন্যায়। কিন্তু সমাজে প্রচলিত অন্য অন্যায়গুলির মতো ইহাও চলিয়া আসিতেছে। আশা ছিল, সমাজ যত উন্নত হইবে, এই সকল অন্যায়ও ক্রমে লোপ পাইবে। কিন্তু তাহা হয় নাই। বস্তুত, ঘটিয়াছে তাহার বিপরীত। ইদানীং যে গণপিটুনির ঘটনাগুলি শিরোনামে উঠিয়া আসিতেছে, তাহা দেখিয়া পূর্বের ঘটনাগুলিকে যেন মামুলি, নিরীহ বোধ হইতেছে। সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনাকে ভয়াবহ পৈশাচিকতার প্রতিচ্ছবি বলিলে ভুল হইবে না। চোর সন্দেহে টোটোচালককে প্রহার করিবার সময় যদি জনতার হাতে স্টিল পাঞ্চার, হকি স্টিক উঠিয়া আসে, ‘অপরাধী’র চক্ষে লঙ্কার গুঁড়া ভরিয়া দেওয়া হয়, মানসিক ভারসাম্যহীনকে বাতিস্তম্ভে বাঁধিয়া বাঁশপেটা করা হয়, তবে বুঝিতে হয়, সমাজের মানসিকতায় এক ভয়ঙ্কর পরিবর্তন আসিয়াছে।

Advertisement

কেন ‘শাস্তি’ দিবার এই পৈশাচিকতা? গণপিটুনির প্রাদুর্ভাবের কারণ হিসাবে সচরাচর বলা হয়— মানুষ পুলিশ-প্রশাসনের উপর আস্থা হারাইয়া ফেলিলে ক্ষোভের এমন উদগ্র বহিঃপ্রকাশ দেখা যাইতে পারে। পূর্ববর্তী জমানা হইতেই, বঙ্গদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে হাল, তাহাতে পুলিশ-প্রশাসনের উপর যথেষ্ট আস্থা থাকিবার কথা নহে। অপরাধী ধরিবার কাজটি পুলিশের। কিন্তু নানা কারণে পুলিশ তাহার কর্তব্য পালনে অপারগ বা অনিচ্ছুক। ফলে জনতা আসরে নামে। বিশেষত, কোনও এলাকায় একই ধরনের অপরাধ বারংবার ঘটিতে থাকিলে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তখন চটজলদি সমাধান খোঁজে এবং সেই ক্ষোভ নির্দোষের উপরও বর্ষিত হইতে পারে, শাস্তিদানের প্রক্রিয়াটিও ব্যাকরণের তোয়াক্কা করে না। গণপিটুনির সংখ্যা এবং ভয়াবহতা বৃদ্ধি পায়। ‘পরিবর্তন’-এর পর বঙ্গবাসী আশা রাখিয়াছিল সেই সুদিন আসিবার। দশক অতিক্রান্ত হইতে চলিয়াছে, সুদিন আসে নাই। বরং অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি, অকর্মণ্যতা, অরাজকতা আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। সংশয় হয়— অপরাধ এবং অপরাধীর উপর প্রশাসনের কল্যাণহস্তটি আরও দৃঢ় ভাবে স্থাপিত হইয়াছে। অতএব মানুষও সামান্য ব্যাপারে আইন নিজ হস্তে তুলিয়া লইতেছেন।

পুলিশ-প্রশাসন তাহার দায়িত্ব পালন করে না, এই অভিযোগ সত্য। গুরুত্বপূর্ণও। কিন্তু দায়িত্ব সমাজেরও আছে। হিংস্র হঠকারিতাকে প্রশ্রয় না দিয়া শুভবুদ্ধির শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব। সমাজও সেই দায়িত্ব পালনে উত্তরোত্তর ব্যর্থ। গণপিটুনি সামাজিক হিংস্রতার একটি দিকমাত্র। সার্বিক ভাবেই সমাজে হিংস্র মনোবৃত্তি ও আচরণের প্রকাশ বাড়িতেছে। পান হইতে চুন খসিলে মানুষ হিংসার আশ্রয় লইতেছে। চুরির সন্দেহ, প্রতারণার অভিযোগ, ‘প্রেম’-এ প্রত্যাখ্যান, ‘অবৈধ’ সম্পর্ক— শাস্তি তাৎক্ষণিক এবং নৃশংস। এমন হিংস্র সমাজ যে রাজনীতিকে ধারণ ও লালন করে, তাহাও উত্তরোত্তর হিংস্র হইয়া উঠিবে, অস্বাভাবিক নহে। দৈনন্দিন রাজনৈতিক হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ যে আজ কার্যত ভারতসেরা, তাহার পিছনে এই সমাজের অবদান অনস্বীকার্য। সমাজ বদলানো রাজনীতির নায়কনায়িকাদের দায়িত্ব। কিন্তু সেই দায়িত্ব তো তাঁহারা কবেই ভাগীরথীর পঙ্কিল জলে ভাসাইয়া দিয়াছেন।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন