সবাই ক্রিকেট বোঝে, যুদ্ধও

ময়দানে যাঁরা খেলেন তাঁরাও করেন না। তাঁরা জানেন, কোন বলের কী দাওয়াই। সুতরাং, কেদারায় বসে বলা ‘ফ্রন্টফুট-ব্যাকফুট’-এর দোলাচলে তাঁরা ভোগেন না। 

Advertisement

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:১০
Share:

যুদ্ধ এবং ক্রিকেট— বড্ড বেশি মিল পাই আজকাল। সবাই ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ, প্রত্যেকে যুদ্ধবিশারদ। লিলি মার্শালদের গতি এবং সুইং গাওস্করের, আক্রম ইউনিসদের তেন্ডুলকরের এবং হালে অ্যান্ডারসনকে কোহালির কী ভাবে খেলা উচিত, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। ছোটবেলায় বড়দের (যাঁরা লাল বলে কখনও খেলেছেন বলে অভিযোগ ওঠেনি) মুখে শুনেছি, ‘‘ওই বলটা ফরওয়ার্ড খেলা উচিত ছিল, ব্যাকফুটে খেলতে গেল বলেই না...।’’ কৈশোরে-যৌবনে শুনেছি, ‘‘(সুইং) ভাঙার আগেই খেলতে হত।’’ মাঝ বয়সে এসেও স্বঘোষিত ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের বলতে শুনি, ‘‘ইস, আর একটু পরে খেলতে পারল না!’’

Advertisement

গা করিনি। ময়দানে যাঁরা খেলেন তাঁরাও করেন না। তাঁরা জানেন, কোন বলের কী দাওয়াই। সুতরাং, কেদারায় বসে বলা ‘ফ্রন্টফুট-ব্যাকফুট’-এর দোলাচলে তাঁরা ভোগেন না।

হালে পুলওয়ামায় গাড়ি-বোমা বিস্ফোরণের পরে, জনতার একাংশ যে ভাবে ‘ফ্রন্টফুট-ব্যাকফুট’ (সামরিক প্রকরণে যেন লেফট-রাইট) করতে লেগেছে, মনে হচ্ছে যুদ্ধ এবং সে সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাকরণ তাঁদের নখদর্পণে। হাতে ‘অ্যাসল্ট রাইফেল’ (অনেকে অ্যাসল্ট কথাটাতে চোখে পড়ার মতো জোর দেন), পরনে ‘ব্যাটল ফেটিগ’ (‌এ বার জোর ব্যাটলে) পরিয়ে দিলেই তাঁরা ময়দানে নেমে পড়বেন এবং নিকেশ করে ফেলবেন। ‘‘কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে, শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।’’

Advertisement

গায়ে কাঁটাই দিচ্ছে। যুদ্ধের অগ্রপশ্চাৎ ভাবার প্রয়োজন নেই। স্রেফ মারার স্বাধীনতাটুকু পেলেই যেন কেল্লা ফতে। এ জলতরঙ্গ রোধিবে কে? যারা সামান্য উজানে সাঁতরাতে চাইছেন, তাঁরা এখন গণশত্রু। দেশদ্রোহী। ‘পাকি’।

এই সে দিন পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরে এক সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ঘটনাই ধরা যাক। তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্র যুদ্ধ নিয়ে নিজস্ব মতামত লিখেছিলেন ‘ফেসবুক’-এ। অভিযোগ, সেই ‘অপরাধ’-এ ঘরে ঢুকে তাঁকে নিগ্রহ করেন অন্য ছাত্রদের একাংশ। মুছতে বাধ্য করা হয় ‘পোস্ট’টি। এমনও দেখা গেল ক’দিন— ‘ফেসবুক’-এই স্বঘোষিত সমাজ সংস্কারকেরা আগাম হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন রঘু ডাকাতের ঘরানায়। ‘‘আজ অমুককে শিক্ষা দিলাম। ভিডিয়ো দেখুন। কাল তমুকের পালা।’’ যেন এ ভাবে ‘শিক্ষা’ দেওয়াটা তাঁদের সাংবিধানিক অধিকার।

আর রয়েছেন বিদেশ নীতি ‘সচেতন’ বিদ্বজ্জনেরা। তাঁরাও ‘ফেসবুক’ এবং ‘টুইটার’-এ নানা ধরনের কর্তব্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন। কী ভাবে সেনা ভিনদেশে ঢুকবে, কী ভাবে পুলওয়ামার বদলায় ‘উরি-২’ (সিনেমা) হবে, পাকিস্তান এবং চিনকে কী কী উপায়ে শিক্ষা দেওয়া যাবে— বিচার, মত এবং বিশ্লেষণের অবধি নেই। ‘‘হাউ ইজ় দ্য জোশ? হাই স্যর।’’ অতএব, ফাগুন মাসেই আষাঢ়ের আহ্বান। ‘চল নামি’।

বলা সহজ। করা কঠিন। কেদারা-সেনানীদের মাথাতেই আসছে না, যে জওয়ানদের ভিনদেশে বদলা নিতে পাঠানোর এমন উদগ্র বাসনা তাঁদের, তাঁরাও কারও ছেলে, কারও বাবা, কারও স্বামী, কারও ভাই। পুলওয়ামায় নিহত জওয়ানদের বদলা নিতে গিয়ে দলে দলে প্রাণ দেওয়ায় আর যা-ই থাক, বিচক্ষণতার ছাপ নেই। সেনা কর্তৃপক্ষ তেমন করতে চান বলে মনেও হয় না। তবুও বলা থামছে না। কারণ, অঢেল ‘পরিসর’ আছে।

পরিসর! এত দিনে বুঝলাম শব্দটির ব্যাপ্তি। ‘ইন্টারনেট’ এবং ‘ফেসবুক’-এর আগেও বহু বার যুদ্ধ হয়েছে। সে আমলেও নিশ্চয় হানা বা হামলার প্রতিক্রিয়া হত জনমানসে। শুধু প্রতিক্রিয়াগুলো বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে পড়ত না। ছড়িয়ে পড়া ইস্তক আরও প্রতিক্রিয়া এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখে বুঝতে বাধ্য হচ্ছি পরিসর বস্তুটির প্রকৃত অর্থ। পরিসর কমে গেলে অস্বস্তি স্বাভাবিক। পরিসরের ব্যাপ্তি উপলব্ধি করতে গিয়েও এখন ঢোক গিলছি।

ইন্টারনেটের অসীম পরিসরে যা ইচ্ছে তা-ই বলার যে ছুট ছিল, সেটাই এখন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আগে যে গুজব ছড়াতে তিন দিন লাগত, তা এখন ছড়িয়ে যাচ্ছে তিন সেকেন্ডে। পেলাম, ‘ফরওয়ার্ড’ বা ‘রিটুইট’ করলাম। সঙ্গে জুড়ে দিলাম ‘কমেন্ট’, ‘ইমোজি’, ‘হ্যাশট্যাগ’। গায়ের জ্বালা আগুন হয়ে কাউকে পুড়িয়ে দিল কি না, এই সংবেদনশীলতা বা অনুভূতিপ্রবণতার জায়গাটা ক্রমে ‘নেই’ হয়ে যাচ্ছে অনেকের ক্ষেত্রে।

সে সুযোগ নিচ্ছে কিছু মওকা খোঁজা লোক। পুলওয়ামায় আক্রমণের পরে, মুম্বইয়ের বিনোদন জগতে কাজ করা কিছু পাকিস্তানি শিল্পীকে কেন প্রেমের গান গাইতে দেওয়া হচ্ছে বলে নিয়মিত ক্ষোভ প্রকাশ করছেন এ দেশের এক গায়ক। আর তাঁর অনুরাগীরা ‘খুনের বদলা খুন, জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও’ গোত্রের জিগির তুলছেন। এঁরা ভাবছেন, আগুন এঁদের পোড়াবে না। পুড়বে অন্য লোক। আগুন বাছবিচার করে না— এটুকু বোঝার ক্ষমতা এঁদের নেই। আর জওয়ানদের মতো সহনশীলতা, তার তো প্রশ্নই ওঠে না।

অভিধান বলছে, ‘পরিসর’ শব্দের অর্থ ব্যাপ্তি, বিস্তার, বিস্তৃতি, সীমা, মাপ। ক্রিকেট-যুদ্ধে ব্যাট আর ‘প্যাড’-এর মধ্যে ফাঁকের মাপটা যত কম হয়, ততই ভাল। কেদারা-সেনানীদের জন্যও এই নিয়ম খাটা উচিত। যা না মানলে যে কোনও সময় ‘ক্লিন বোল্ড’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন