পুরনো আমেরিকার ছোঁয়া যে একেবারেই হারিয়ে গিয়েছে, তা নয়

ষাট বছর আগে ও পরে

আরও শিখলাম ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বললে ফিরে বলতে হয় ‘ইউ আর ওয়েলকাম’। ইংরেজি প্রথা অনুসারে শেখানো হত ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বললে ফিরে বলতে হবে ‘ডোন্ট মেনশন’।

Advertisement

কৃষ্ণা বসু

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৩৩
Share:

বস্টন শহরে পদার্পণ করেছিলাম সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ সালে। আর সদ্য এ বার গেলাম সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে। বস্টন শহরে পদার্পণের ষাট বছর পূর্তি উৎসব পালন করলাম সেখানকার বন্ধুজনের সঙ্গে। বস্টন এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসার কেন এসেছি প্রশ্নের জবাবে যখন বললাম, ষাট বছর পূর্তি উৎসব করতে এসেছি; তিনি হেসে ফেললেন। অবশ্য এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আমি এ শহরে বার বার এসেছি। এক সময়ে কলেজে অধ্যয়নরত পুত্র-কন্যাদের দেখতে নিত্য আসা-যাওয়া। পরবর্তী কালে জনজীবনে প্রবেশ করে সাংসদ হলাম। তখন নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশন বা ওয়াশিংটনে পার্লামেন্টের কাজে এসেছি। তবে যত কাজই থাক বস্টনে কয়েক দিন কাটাতেই হবে। ১৯৫৮ সালের বস্টন শহরে শাড়ি-পরিহিতা ভারতীয় রমণী পথচারীদের কৌতূহল উদ্রেক করত। ‘‘এই ড্রেসটা কী ভাবে পরা হয়, মাথা গলিয়ে পরতে হবে’’ এই ধরনের প্রশ্নের জবাব দিতে হয় পথে ঘাটে। কিন্তু সবাই বন্ধুভাবাপন্ন। পরদেশি অতিথিকে আপন করে নেওয়ার আগ্রহ। ভারত দেশটা সম্পর্কে তাদের অবশ্য বিশেষ ধারণা নেই। সাপ আর বাঘের দেশ বলে এক অস্পষ্ট, আজব মনোভাব কাজ করে।

Advertisement

অবশ্য আমাদের কাছেও সেই সময়ে আমেরিকা ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’। আমেরিকা চলেছি শুনে কলকাতার এক ইংরেজ বন্ধু ভয় দেখালেন, ‘‘ওদের ভাষা জানো তো? ওদের ইংরেজি একেবারে অন্য রকম।’’ হয়তো কোনও কথাবার্তায় বিশেষ ‘আইডিয়া’ নিয়ে কিছু বলছি, আমেরিকান পরিচিত জন বললেন— তোমার আইডিয়া আমি কিনব না, আই উইল নট বাই ইয়োর আইডিয়া। এই রকম কেনাবেচার ভাষায় ইংরেজি তখন সত্যিই বেসুরো ঠেকত।

আমার অবশ্য নিতান্ত বালিকা বয়স থেকে আমেরিকার সঙ্গে অল্পস্বল্প পরিচয় ছিল। আমার স্বদেশি বিপ্লবী দাদু তার পুত্রদের কিছুতেই ইংরেজদের অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে পাঠাবেন না। এক পুত্রকে পাঠালেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, অপর জনকে এমআইটি। এমআইটি-তে অধ্যয়নরত মামা বস্টনবাসিনী আমেরিকান মামিমাকে নিয়ে দেশে ফিরলেন। তার ফলে সেই ছোটবেলা থেকে জানি এই পৃথিবীতে ‘নিউ ইংল্যান্ড’ বলে একটি জায়গা আছে আর সেখানে খুব ঠান্ডা।

Advertisement

আরও শিখলাম ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বললে ফিরে বলতে হয় ‘ইউ আর ওয়েলকাম’। ইংরেজি প্রথা অনুসারে শেখানো হত ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বললে ফিরে বলতে হবে ‘ডোন্ট মেনশন’।

ষাট বছর আগে আমার হান্টিংটন অ্যাভিনিউয়ের বাসস্থানের ঠিক উল্টো দিকে ছিল হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল, পাশের লংউড অ্যাভিনিউতে বস্টন চিলড্রেন হসপিটাল। এই দুই জায়গায় কর্মরত আমার স্বামী ডা. শিশির কুমার বসু। শিশু হাসপাতাল তো খুবই বিখ্যাত আর পুরো এলাকা জুড়েই বড় বড় হাসপাতাল। আমেরিকার যে কোনও প্রান্ত থেকে গুরুতর অসুস্থ শিশুকে আসতে হবে শিশু হাসপাতালে। মনে পড়ছে ওই সময়ে জন ও জ্যাকি কেনেডির একটি বেবিকে আনা হয়েছিল শিশু হাসপাতালে। তবে বাচ্চাটিকে বাঁচানো যায়নি। অপর দিকে আছে মায়েদের জন্য বিখ্যাত বস্টন লাইং-ইন হাসপাতাল। আর প্রায় বাড়ির পাশেই পিটার ব্রেন্ট ব্রিগ হ্যাম হাসপাতাল, জায়গাটার নামই পিটার ব্রেন্ট ব্রিগ হ্যাম সার্কেল। ষাট বছর পরে গিয়ে লংউড এলাকায় গিয়ে দেখলাম এখনও জমজমাট হাসপাতাল এলাকা, তবে অট্টালিকাগুলির অনেক আধুনিক চেহারা ব্রিগ হ্যাম অ্যান্ড উইমেন নতুন নামের হাসপাতালে ঢুকে এক বার ডাক্তার দেখিয়েও নিলাম। হাসপাতালে ঢুকলে মনে হয় পাঁচতারা হোটেলে প্রবেশ করলাম, সব কিছু ঝকঝকে তকতকে। দেশের হাসপাতালের জীর্ণ, মলিন চেহারা মনে পড়ে যায়, কষ্ট হয়।

সেই প্রথম ১৯৫৮ সালের বস্টন শহরে এসে আমার আমেরিকানদের খুব ভাল লেগে গেল। মনে হল এরা খুব বন্ধুভাবাপন্ন। এখন বুঝতে পারি এই ভাল লাগার পিছনে এক ধরনের মানসিকতা কাজ করেছিল। আমরা এক দশক আগে স্বাধীন হয়েছি, স্মৃতিতে আছে ব্রিটিশ শাসনের সময়কাল তাদের সঙ্গে ছিল প্রভু-প্রজার সম্পর্ক, তাই তুলনায় আমেরিকানদের মনে হল অনেক বেশি মুক্তমনা। আমেরিকানদের পেলাম একটি মিশ্র সমাজ, কেউ আইরিশ আমেরিকান, কেউ-বা পোলিশ আমেরিকান নয়তো ব্রিটিশ আমেরিকান, বিশুদ্ধ আমেরিকান কেউ নেই। আরও দেখেছিলাম এরা খুব চাইল্ড-ফ্রেন্ডলি অর্থাৎ শিশুপ্রেমিক। যে কোনও অনুষ্ঠানে যেতাম এমনকি গির্জায় প্রার্থনা করতে গেলেও ছোটদের দেখভাল করার ব্যবস্থা আছে। মায়েরা বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে যান। প্রথম এক আমেরিকান গৃহে নিমন্ত্রণ এলে পর ডা. শিশির বসু জানালেন তিনি যাবেন, কিন্তু স্ত্রী যেতে পারবেন না সঙ্গে শিশুপুত্র আছে। আমেরিকান নিমন্ত্রণকর্তা ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘‘উই আর নট অ্যাফরেড অব চিলড্রেন, আই হ্যাভ ফোর।’’ অর্থাৎ আমরা বাচ্চাদের ভয় পাই না, আমার নিজের চারটি আছে। সেই নিমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করেছিলাম। শিশুপুত্রের হাত ধরে এক বিদেশিনি পথে চলেছি সবাই থামিয়ে গল্প জুড়ে দেবে, বলবে, ইজ় নট হি কিউট— কী মিষ্টি বাচ্চা!

অনেক ভারতীয় বন্ধু আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন তুমি যে সময়ের কথা বলছ তখন কালোদের প্রতি সাদা আমেরিকানরা অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করছিল, সেটা কি তোমার চোখে পড়েনি? হার্ভার্ড অ্যাকাডেমিক পরিবেশে তেমন কট্টর বর্ণবিদ্বেষ দেখতে পাইনি। তবে আমার পাড়ার একেবারে শেষ প্রান্তে একটিমাত্র বাড়িতে এক কালো পরিবার থাকতেন। পাড়ার অনেক বাচ্চারাই ভারতীয় শিশুপুত্রের সঙ্গে খেলা করতে আসত। এক দিন দেখলাম দু’টি কালো বালক-বালিকা সেই প্রত্যন্ত বাড়ি থেকে এসে খেলায় যোগ দিয়েছে। কয়েক দিন পরে খেলার সাথি এক সাদা বালিকার নাম হেলেন আমাকে বলল, মিসেস বোস, তোমার শিশুপুত্রকে ওদের সঙ্গে মিশতে দিয়ো না। কারণ জিজ্ঞাসা করাতে বলেছিল, ওরা ভাল লোক নয়। ক’দিন পরেই দেখি আমার বারান্দায় সব বাচ্চারা মিলে খেলা খুব জমেছে। জিজ্ঞাসা করলাম কী খেলা হচ্ছে, হেলেন জবাবে বলল, উই আর প্লেয়িং হাউস। তাদের সেই বাড়ি বাড়ি খেলাতে হেলেন হয়েছে মা, কালো ছেলেটি বাবা আর ভারতীয় শিশু তাদের ছেলে। ছোটদের মনে নেই কোনও গ্লানি বা সঙ্কীর্ণতা। আমার বান্ধবী মিসেস চুজ়োম ছিলেন সঙ্কীর্ণমনা এবং কট্টর বর্ণবিদ্বেষী। ‘ডটারস অব আমেরিকান রেভলিউশন’ নামে এক কনজ়ারভেটিভ প্রতিষ্ঠানের সদস্য। আমাকে তিনি সেই বিপ্লবী কন্যাদের সংস্থার সদস্য করে নিয়েছিলেন, প্রায়ই তাঁদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। আমার প্রতি বন্ধুবৎসল হলেও তাঁর মধ্যে জাতিবিদ্বেষ ছিল প্রবল।

ষাট বছর পূর্তি উৎসব করতে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে যখন আমেরিকা চলেছি, তখন মনে জানি আমার সেই বন্ধুবৎসল আমেরিকা হারিয়ে গিয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করে দিয়েছেন বিদেশিরা এ দেশে মোটেই স্বাগত নন, বলেছেন আমেরিকানস ফার্স্ট। যদিও সেই বিশুদ্ধ আমেরিকান কোথায় পাব জানা নেই। এখন আইরিশ আমেরিকান, ইতালীয় আমেরিকান, ব্রিটিশ আমেরিকানদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিপুল সংখ্যক এশিয়ান আমেরিকান। তাঁদের মধ্যে রয়েছে ভারত, চিন, জাপান থেকে আগত এবং এত দিনে তিন পুরুষের বাসিন্দা সহস্র মানুষ তাঁরা নিজেদের আমেরিকান বলেই জানেন তবুও পুরনো দিনের ছোঁয়া একেবারে পেলাম না, এ কথা সত্য নয়। ষাট বছর আগের তরুণী আজ অশীতিপর বৃদ্ধা, বস্টন এয়ারপোর্টে নেমে চলেছি হুইল চেয়ারে, সকলেই কিন্তু সাহায্যের হাত এগিয়ে দিচ্ছেন। ষাট বছর পূর্তি উৎসব করতে এসেছি বলাতে ইমিগ্রেশন অফিসারের হাসিটাও উল্লেখযোগ্য।

এ বার এলাম ট্রাম্পের জমানায়, ওবামা পরবর্তী আমেরিকায় যে পরিবর্তন আশা করা গিয়েছিল তা সফল হয়নি। ষাট বছর আগের আমেরিকায় কালো মানুষেরা সিভিল রাইটস-এর জন্য সংগ্রাম করছিলেন। কিন্তু কিছু আইনি অধিকার পেলেও আজও তাঁরা ব্রাত্যই আছেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এশিয়া থেকে আগত ও তিন পুরুষ ধরে বসবাসকারী এশিয়ান-আমেরিকান। আমেরিকান সংবিধান অনুসারে আমেরিকার মাটিতে জন্মগ্রহণ করলেই সে আমেরিকান নাগরিক হিসেবে গণ্য হত। সেই জন্মগত নাগরিকত্বের অধিকারও এখন কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। মানুষে মানুষে বিভেদের চেষ্টার এই দোলাচলের মধ্যেই এক অন্য ধরনের ষাট বছর পূর্তি উৎসব পালন করে এলাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন