অশ্বমেধ: কলকাতা সফরকালীন শিয়ালদহে জনসংযোগে ব্যস্ত সর্বভারতীয় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, ২৬ এপ্রিল। ছবি: পিটিআই
অমিত শাহ ১৯৮০ সাল থেকে নিয়মিত ডায়েরি লিখছেন। তিন দশকে এক দিনও মিস হয়নি। প্রতি দিন তিনি কী করছেন, কোথায় যাচ্ছেন, কী অভিজ্ঞতা হল, এ সব লিখে রাখেন। আর সবশেষে থাকে দুটি বিশেষ উপলব্ধি। সে দিন রাজধানীর লীলা প্যালেস হোটেলে এবিপি-নিউজ চ্যানেলের শিখর সম্মেলন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন অমিতভাই। সাক্ষাৎকার-পর্ব শুরু হওয়ার আগে লাউঞ্জে বসে আড্ডা মারছিলেন চিনি ছাড়া কালো কফি খেতে খেতে। তখনই জানলাম ডায়েরির গল্প।
সতীর্থ সাংবাদিক দিবাং ওকে বলল, ’৮০ সাল থেকে তাহলে প্রতি দিন একপাতা করে লিখলেও সাড়ে ১৩ হাজার পৃষ্ঠা লেখা হয়ে গিয়েছে! অমিত শাহ বললেন, প্রতি দিন এক পাতা কেন? অনেক সময়ই আরও বেশি পৃষ্ঠা লিখেছি। যেমন মা যখন মারা গেলেন, সেদিন তো অনেক বেশি লিখেছিলাম।
অসম্ভব ‘ডিসিপ্লিন’ মানুষটার জীবনে। অমিতের নিজের কথায়, ‘আরএসএস আমাকে এই শৃঙ্খলাটা শিখিয়েছে।’ উনি কথা বলছিলেন, আর আমি নিবিষ্ট চিত্তে ওঁর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, ইংরেজরা একটা কথা শিখিয়েছিল, শয়তানকেও তাঁর কৃতিত্বটুকু দিতে কার্পণ্য করো না। অমিত শাহের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে আমার-আপনার অনেকের মত-পার্থক্য আছে। শুধু নীতি নয়, কাজের ধরন নিয়েও প্রশ্ন আছে। কিন্তু আমি ত্রিশ বছরেরও বেশি বিজেপি দলটির বিষয়ে খবর রেখে আসছি এক জন সংবাদ-কর্মী হিসাবে, এমন কাজপাগল পরিশ্রমী দলের সভাপতি বেশি দেখিনি। যা করেন, নিয়ম মেনে করেন। প্রধানমন্ত্রীকে প্রত্যহ ঠিক কোন সময়ে ফোন করবেন সেটা পর্যন্ত নির্ধারিত। বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করেন না। প্রতি মাসে ২০ হাজার কিলোমিটার সফর করছেন। পাঁচ মাসে এক লাখ কিলোমিটার ঘুরবেন, এমনই পরিকল্পনা। ভাবা যায়? বলছিলাম, উত্তরপ্রদেশ জেতার পর কোথায় গরমের ছুটি নিয়ে সুইটজারল্যান্ড বেড়াতে চলে যাবেন, তা নয়, বাংলা-ত্রিপুরা থেকে লাক্ষাদ্বীপ: কোথায় কোথায় ঘুরছেন! দিবাং বলেই বসল, আপ চাহতে ক্যায়া হ্যায়?
জবাব একটাই। গোটা দেশে বিজেপির শ্রীবৃদ্ধি। ‘প্যান-ইন্ডিয়ান’ পার্টি করতে হবে বিজেপিকে। বাজপেয়ী-যুগে আডবাণীকেও দলের সভাপতি পদে দেখেছি। তিনিও পরিশ্রমী ও সুশৃঙ্খল ছিলেন, কিন্তু এমন ‘সিঙ্গলনেস অফ পারপাস’ বা একাগ্রতা আর কারও মধ্যে দেখিনি। আডবাণী বই পড়তেন, সিনেমা দেখতেন। অমিত শাহের এই দুটি বিষয়েই আগ্রহ কম। তবে শাস্ত্রীয় সংগীত শিখেছেন তিনি, কলকাতার ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের এক গুরুজির কাছ থেকে।
অমিত শাহের সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র দুটি। কৌটিল্য এবং বীর সাভারকর। ফলে ওঁর মধ্যে বাহ্যত আবেগের উপাদান কম। মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি রক্তমাংসের মানুষ নন, তিনি ইস্পাত দিয়ে গড়া। ধাতব ব্যক্তিত্ব। বাজে কথা বলে, আড্ডা মেরে, দিল্লির রাজনীতিকদের স্টাইলে দরবার করেও তিনি সময় নষ্ট করেন না। বিজেপির বিজয়পতাকা উড্ডয়নে তিনি কৌটিল্য। সাম-দান-দণ্ড-ভেদ সবনীতিই অনুসরণ করেন। সাফল্যের জন্য এই রিয়েলপলিটিক-এর মধ্যে কালিমা-ক্লেদ আছে। নেপথ্যে আছে অনেক অনৈতিক কর্মকাণ্ড। কখনও মেরুকরণের রাজনীতি, ওয়াইসির মতো কট্টর মৌলবাদী নেতাদের ব্যবহার করে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা, আছে দাদরি থেকে মুজফ্ফরনগরের অশান্তিকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করা, তিন তালাক থেকে সিবিআই অথবা আর্থিক গোয়েন্দা শাখা নানা অস্ত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। আর এই সব অপারেশন অনেকটা গডফাদারের স্টাইলে। প্রেম এবং যুদ্ধে নৈতিকতার প্রশ্ন তো অপ্রাসঙ্গিক! কার্ল মার্ক্সও তো বলেছেন, উচিত লক্ষ্যের জন্য রক্তক্ষয়ী হিংসার উপায়ও গ্রহণীয়। সেই সাবেকি পথ আর গন্তব্য-এর তত্ত্ব মানছেন গাঁধীর রাজ্যের মানুষ অমিত শাহ।
আঠারো বছর বয়সে অমিত শাহ পিভিসি পাইপের ট্রেডিং করেছেন। বাইশ-তেইশ বছর বয়সে তিনি গুজরাতের মানসায় একটা পাইপের কারখানা খুলে ফেলেন। মুম্বইতে জন্মেছেন। ব্যবসা তাঁর রক্তে। অল্পবয়সে মুম্বই স্টক মার্কেটে স্বনামধন্য ‘স্টক ব্রোকারে’ পরিণত হয়ে যান।
বিজেপির এক শীর্ষনেতাকে বলেছিলাম, আসলে অমিতভাই এমন কিছুই করছেন না, যা মতাদর্শগতভাবে নতুন। নতুন বিজেপি আসলে পুরনো রাস্তা দিয়েই হাঁটছে।
নরেন্দ্র মোদীর ‘চিফ অপারেটিং অফিসার’ অমিত শাহ সেই মতাদর্শের প্রেক্ষাপটেই তাঁর অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু করেছেন। তফাত একটাই, তখন এক দিকে যেমন এনডিএ জোটের অন্য শরিক মমতা-জয়ললিতা অথবা নীতীশ-নবীনবাবুর মতো ব্যক্তিত্ব ধর্মনিরপেক্ষ পথে হাঁটতে বাজপেয়ীকে বাধ্য করেছিলেন, এখন সেই বাধ্যবাধকতা নেই। ২৮২টি আসনের শাসক দল। তিন বছর পর উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে এহেন ভয়ঙ্কর জয়লাভ। এর ফলে তিন বছরের স্থিতাবস্থা-বিরোধিতার তত্ত্বকে শুকনো পাতার মতো মাড়িয়ে অমিত শাহ আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছেন। তবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার তাপমাত্রা তো আছেই, এর সঙ্গে আছে মোদী-অমিত শাহের কম্বো স্টাইল। এ এক অভিনব গুরুশিষ্য সংবাদ। অমিত শাহ যেন এই আধুনিক জমানার রাজনীতির নিজস্ব ভাষার গর্ভ থেকেই জন্ম নিয়েছেন। অমিত শাহের রাজনীতির ‘ন্যারেটিভ’-এ নীতি ও আদর্শ নিয়ে গুরুগম্ভীর বিতর্ক নেই, উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন নিয়ে কোনও কুয়াশা নেই। মন্ত্র একটাই, ‘উই হ্যাভ টু অ্যাচিভ।’ এবং, ‘উই ক্যান, সো উই উইল।’
দেখুন, কংগ্রেস ও অন্য রাজনৈতিক দল থেকে বিজেপিতে লোক নিয়ে এসে কংগ্রেসের মনোবল ভাঙার কাজটিও আডবাণী শুরু করেন। কিন্তু তখন এ ভাবে যেনতেন প্রকারে দলে নিয়ে এসে কংগ্রেসের ভেতর মড়ক লাগানোর চেষ্টা ছিল না। বিজেপির এক শীর্ষ নেতাই বাজপেয়ী জমানার সঙ্গে আজকের অমিত শাহের অধ্যায়ের তফাত বোঝাতে গিয়ে বললেন, মতাদর্শগত ভাবনার পটভুমি সে দিনও যা ছিল আজও তা আছে। কিন্তু বাজপেয়ী-আডবাণী জমানাটা ছিল পদ্যের যুগ। আর আজ মোদী-অমিত শাহের রাজনীতি এনেছে গদ্যের যুগ।
পদ্য থেকে গদ্যে রূপান্তরের মহানায়ক হলেন অমিত শাহ। উত্তরপ্রদেশ থেকে দাঙ্গার খবর আসছে। জাতিদাঙ্গা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাংলার মতো রাজ্যেও বাড়ছে। অখণ্ড ভারতের কথা বললেও বিভাজনের রাজনীতি ক্রমবর্ধমান। আজকের রাজনীতিতে বোধ হয় এটাকেই বলা হয় বাস্তবতার রাজনীতি। আরও বেশি সংখ্যক মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্য পাগলের মতো কাজ করে চলেছেন অমিত শাহ। হাই সুগার তাঁর। ছোট প্রাইভেট বিমানে বসে একটা জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ওড়ার আগে নিজেই পেটে ইনজেকশন দেন। তার পর সে শহরে পৌঁছে শুরু করেন তাঁর নিজের স্টাইলে, পদ্য নয়, গদ্যময় রাজনীতি। বিরোধী নেতারা দেখে কিছু শিখতেও পারেন।