যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা লইয়া বিতণ্ডা একটি বাৎসরিক অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হইতে বসিয়াছে। এই বৎসরও ‘প্রস্তাব’ আসিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগে একই ভাবে প্রবেশিকা পরীক্ষার পরিবর্তে বোর্ড পরীক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হউক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল-এর বৈঠকে সেই প্রস্তাব অগ্রাহ্য হইল— ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ ইহাতে অরাজি। তাঁহারা পুরাপুরি প্রবেশিকা পরীক্ষার উপরই ভরসা রাখিতে চান, বরাবরের ঐতিহ্য অনুসারে। যুক্তিটি পরিষ্কার। অনেক ছাত্রছাত্রীরই অনেক কারণে প্রবেশিকা পরীক্ষার নম্বর ভাল হয় না। দিল্লি বোর্ডের তুলনায় রাজ্য বোর্ড এখনও কম নম্বর দেয়, তাই বোর্ডে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি তালিকা প্রকাশ করিলে রাজ্য বোর্ডের ছাত্রছাত্রীরা পিছনে পড়িয়া যায়। একটিমাত্র প্রবেশিকা পরীক্ষা হইলেই সে ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার সম্ভব— সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে তখন সমান তলে বসাইয়া বিচারের সুযোগ মিলে।
অন্য একটি বিষয়ও গুরুতর। বিদ্যালয় স্তরে ভাষা-সাহিত্যে অনেক নম্বর পাইলেই প্রমাণিত হয় না যে পড়ুয়াটি সাহিত্যপাঠে আগ্রহী। পাঠ্যক্রম বা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যে ভাবে তৈরি করা হয়, তাহাতে সাহিত্যপ্রীতির বিষয়টি প্রমাণের কোনও স্থান থাকে না, সম্ভবত উদ্দেশ্যও থাকে না। পড়া মুখস্থ করিয়া পরীক্ষায় গুছাইয়া উত্তর লিখিতে পারার সহিত একটি সাহিত্যাংশ পড়িয়া তাহার স্বাদগ্রহণ কিংবা তাহার বিচারক্ষমতার কোনও সম্পর্ক নাই। তাই ইংরেজিতে কম নম্বর পাইয়াও ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরে কেহ দুর্দান্ত পড়াশোনা করিতে পারেন। উভয়ের মধ্যে বিরোধ থাকিতেই পারে। বাস্তবিক, অনেকে বলিবেন, বিরোধ থাকাটাই স্বাভাবিক! বোর্ডের পরীক্ষার তুলনায় বিভাগীয় শিক্ষকদের বিবেচনাপ্রসূত প্রশ্নপত্রে যে সাহিত্যপাঠের যোগ্যতা বিচারের সুযোগটি বেশি, ইহা লইয়া তাই তর্ক থাকিতে পারে না।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এই সূত্রেই আসে শেষ, তথা সর্বপ্রধান, কথাটি। ইংরেজি প্রবাদবাক্য বলে: লিভ এডুকেশন টু এডুকেটর্স। শিক্ষকদের হাতেই শিক্ষার বিষয়টি ছাড়িয়া দিলে ভাল, অন্য বিষয়ের কারবারিরা তাহাতে যত কম হস্তক্ষেপ করিবেন ততই মঙ্গল। এই যে প্রস্তাবটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে আসিয়াছে, তাহার রচয়িতা কে, সকলেই জানেন। রাজ্য সরকার কেন এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিবে? কেন শিক্ষা মন্ত্রক একটি স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরকার প্রশাসনিক বিষয়ে মাথা ঘামাইবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগে একই নীতিতে প্রবেশিকা পরীক্ষা লওয়াই যে সর্বোত্তম মডেল, এমনই বা কে বলিয়া দিল? বিশ্ববিদ্যালয় মাত্রেই স্বশাসনের দাবিদার। কী ভাবে প্রবেশিকা পরীক্ষা লওয়া হইবে, তাহা একান্ত ভাবেই স্বশাসনের এলাকার মধ্যে পড়ে। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সহিত কোনও বিভাগের বাদবিতণ্ডা উপস্থিত হইলেও না হয় কথা ছিল। এ ক্ষেত্রে তাহাও হয় নাই, শান্তিপূর্ণ ভাবেই কাউন্সিল সিদ্ধান্তগ্রহণ করিয়াছে। তবে? বাহিরের লোক ক্ষমতা দেখাইবেন কেন? বিশেষত রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিভাগগুলির ক্ষেত্রে? এই মাথা-গলানোর রোগটি পশ্চিমবঙ্গে নূতন নহে। তাহাতে যে রাজ্যের কত দূর সর্বনাশ হইয়াছে, তাহা এখনকার প্রশাসকরাও বিলক্ষণ জানেন। তবুও তাঁহারা দুর্বার দুর্জয়। ভুল পথেই তাঁহারা চলিবেন। বার বার।