মৃত্যু থেকে প্রাণের খোঁজ

আক্ষেপও আছে। ওই তিন হৃৎপিণ্ড দাতার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কেউ নেই। মস্তিষ্কের মৃত্যু হওয়ার পর দেহের প্রত্যঙ্গ দানের ঘটনা এ রাজ্যে ছিল খুব সামান্য।

Advertisement

তাপস রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৮ ০০:১০
Share:

প্রথমে দিলচাঁদ। তার পর সমীরণ দত্ত আর রাখি মণ্ডল। অন্যের হৃৎপিণ্ড গ্রহণ করে তিনটি প্রাণ বাঁচল। কলকাতার চিকিৎসাজগৎ হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের মানচিত্রে জায়গা করে নিতে পারল। গর্বের কথা।

Advertisement

আক্ষেপও আছে। ওই তিন হৃৎপিণ্ড দাতার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কেউ নেই। মস্তিষ্কের মৃত্যু হওয়ার পর দেহের প্রত্যঙ্গ দানের ঘটনা এ রাজ্যে ছিল খুব সামান্য। দিলচাঁদের প্রতিস্থাপনের খবর জানাজানি হওয়ার পর গত মাস দুয়েকে অবশ্য পাঁচ জনকে ‘ব্রেন ডেড’ ঘোষণা করা হয়েছে (যদিও তাঁদের হৃৎপিণ্ড ব্যবহারযোগ্য ছিল না)। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে মস্তিষ্কের মৃত্যুর পর প্রত্যঙ্গ দান যত হয়, পূর্ব ভারতে সে তুলনায় হয় অতি সামান্যই।

হিসেব বলে, যে কোনও দিন, যে কোনও বড় শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে অন্তত আট-দশ জন এমন মানুষ আছেন, যাঁর মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটে গিয়েছে। এঁরা এক এক জন অন্তত সাতটি প্রত্যঙ্গ দান করতে পারতেন। এই মুহূর্তে ভারতে কর্নিয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন দশ লক্ষ দৃষ্টিহীন মানুষ, কিডনির জন্য অপেক্ষা করছেন দু’লক্ষেরও বেশি, হৃৎপিণ্ডের জন্য পঞ্চাশ হাজার, ফুসফুসের জন্য কুড়ি হাজার। অধিকাংশের পরিণাম মৃত্যু।

Advertisement

প্রত্যঙ্গ দান যে মূলত সচেতনতার অভাবে হচ্ছে না, তা বলা চলে না। যে ক’টি প্রত্যঙ্গ দান হয়েছে এ রাজ্যে, অধিকাংশই পরিবারের আগ্রহে। আসলে প্রত্যঙ্গ দান ও তার দ্রুত ব্যবহারের জন্য একটি তৎপর, সক্রিয় ব্যবস্থা প্রয়োজন। দক্ষিণ ভারতে সেটা গড়ে উঠেছে। এ রাজ্যে সবে সূচনা হল।

প্রথম প্রয়োজন, মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটলে তা জানানো আবশ্যক করা। প্রায়ই দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণার ‘হ্যাপা’ নিতে চান না। এই অনাগ্রহ অকারণে নয়। মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘোষণা করার একটি প্রক্রিয়া আছে, রোগীর সব প্রত্যঙ্গ সচল ও সক্রিয় রাখার নানা ব্যবস্থা আছে, আত্মীয়দের বোঝানোর কঠিন কাজটা রয়েছে। তার পরেও আছে প্রতিস্থাপনে আগ্রহী চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ, সমন্বয়। এক জন ব্যস্ত ডাক্তার কী করে এত সময় দেবেন মৃতকে? আর তাঁর তো মনে হতেই পারে, ‘‘আমার লাভ কী? প্রতিস্থাপন করে নামডাক তো হবে অন্য সার্জনের।’’

রোগীর আত্মীয়ের মনেও অনেক সংশয় থাকতে পারে। যেমন, যে প্রত্যঙ্গ দান করা হল, তা নিয়ে ব্যবসা হবে না তো? প্রতিদানে কোনও সহায়তা কি পাব? প্রত্যঙ্গ দানের পর শেষকৃত্যের কী হবে?

তামিলনাড়ুতে এই মুহূর্তে ভারতের সর্বাধিক হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন হচ্ছে। সেখানে সরকারি নির্দেশ আছে, ব্রেন ডেথ ঘটলে ঘোষণা করতেই হবে। স্বেচ্ছাসেবী সমাজকর্মীরা মৃতের আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করে প্রত্যঙ্গ দানের জন্য প্রণোদিত করেন। আইসিসিইউ আছে, এমন প্রতিটি হাসপাতালে ‘ট্রান্সপ্লান্ট কোঅর্ডিনেটর’ আছেন, যাঁরা সকলের মধ্যে সমন্বয় করেন। এক দিকে দেহ থেকে প্রত্যঙ্গ আহরণের প্রক্রিয়া চালু হয়ে যায়। অন্য দিকে, সরকারি নির্দেশে গঠিত ‘আঞ্চলিক প্রতিস্থাপন সংস্থা’ গ্রহীতাকে চিহ্নিত করে, তাঁর চিকিৎসক ও হাসপাতালকে প্রস্তুত হতে বলে।

অনিয়ম, দুর্নীতি রুখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনে ‘ন্যাশনাল অর্গান অ্যান্ড টিস্যু ট্রান্সপ্লান্ট অথরিটি’ (নোটো) কাজ করছে দিল্লিতে। তারাই রাজ্যগুলির উপর নজরদারি করছে। পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি তৈরি হয়েছে রাজ্য প্রতিস্থাপন সংস্থা (রোটো)। তার দফতর এসএসকেএম হাসপাতালে। সরকারি চিকিৎসকেরা তার সদস্য। এঁরাই প্রতিস্থাপনের নিয়ামক। এঁদের কাছে প্রত্যঙ্গের জন্য অপেক্ষারত রোগীদের তালিকা তৈরি থাকছে, দাতার সঙ্গে ‘ম্যাচ’ করে গ্রহীতা চিহ্নিত করবেন এঁরাই।

প্রত্যঙ্গ দানে উৎসাহিত করতে, এবং দাতা ও তাঁর পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে, বেশ কিছু নিয়ম হয়েছে। যেমন, হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন দাতার চিকিৎসার জন্য যা খরচ হয়েছে, তা দেবেন গ্রহীতার পরিবার, এবং যে হাসপাতালে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে তার কর্তৃপক্ষ। গ্রহীতা দরিদ্র হলে হাসপাতালই সব খরচ বহন করে। তামিলনাড়ুতে রাজ্য সরকার প্রতিটি প্রতিস্থাপনের জন্য পঁচিশ লক্ষ টাকা অনুদান দেয়। নোটো-র মাধ্যমে দাতার হাসপাতালে সব খরচ পৌঁছে যায়।

‘ব্রেন ডেথ’ যিনি ঘোষণা করেছেন, সেই চিকিৎসকের অবদানও কম নয়। তাঁকেও সম্মান জানাতে হবে। সেই সঙ্গে, মৃত্যু ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে দায় থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। দাতার ভার গ্রহণ করবেন চিকিৎসকদের অন্য একটি ‘টিম’। দেহের রক্ষণাবেক্ষণের সব ব্যবস্থা তাঁরা করবেন, যত ক্ষণ না প্রতিস্থাপন সম্পূর্ণ হচ্ছে। এই চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য দফতর বা ‘রোটো’ কর্তারা নির্দিষ্ট করে দিতেই পারেন।

গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুই-তিন দিন লাগতে পারে। প্রতি পদক্ষেপে চূড়ান্ত সমন্বয় এবং তৎপরতা প্রয়োজন। অন্য রাজ্যের অভিজ্ঞতা বলে, প্রতিস্থাপনের প্রতি নিবেদিত কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সহযোগিতা করলে সমন্বয় ভাল হয়। দক্ষিণ ভারতে এবং মহারাষ্ট্রে এমন কিছু সংস্থা কাজ করছে। এ রাজ্যেও হয়তো কোনও নিঃস্বার্থ, সেবাপরায়ণ, দক্ষ সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা প্রয়োজন।

শল্যচিকিৎসক, হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন