যে নামেই ডাকো?

পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনে একটি রাজনৈতিক দল ঘোর আপত্তি জানাইয়াছে। তাহার নাম ভারতীয় জনতা পার্টি। বিজেপির মতে, ‘পশ্চিমবঙ্গ‌’ নামটি বাতিল করিয়া দিলে দেশভাগের ইতিহাসও মুছিয়া যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৮ ০০:২৮
Share:

গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

রাজ্যকে প্রথম সারিতে লইয়া আসিবার তবে ইহাও একটি উপায়। খাতায় কলমে নাম ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ হওয়ায় রাজ্যওয়াড়ি তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের ডাক পড়ে সবার শেষে। সর্বত্র। সেই ত্রুটি সংশোধনে গোড়ায় ত্রিফলা নামের প্রস্তাব করিয়াছিল রাজ্য সরকার— বাংলায় ‘বঙ্গ’, হিন্দিতে ‘বঙ্গাল’ আর ইংরাজিতে ‘বেঙ্গল’। সেই প্রস্তাবটি শেষ অবধি নাকচ হইয়া তিন ভাষাতেই একটি নাম স্থির হইল। বাংলা। তিন নাম অপেক্ষা একটি নাম ভাল, নিঃসন্দেহে। কিন্তু, আদৌ নূতন নামের কোনও প্রয়োজন ছিল না। রাজ্যের তালিকার শেষে থাকিবার যুক্তিটি অতি দুর্বল। যে কোনও সরকারি সভায় রাজ্যের নামের ক্রম অনুসারেই ডাকিতে হইবে, এই নিয়মটি অপরিবর্তনীয় নহে। শেষে ডাক পড়িলে যদি আপত্তি থাকে, তবে মুখ্যমন্ত্রী এই প্রথাটি বদলাইবার পক্ষে সওয়াল করিতে পারিতেন। বস্তুত, কিছু সরকারি বৈঠকে নিয়ম আছে, এক দফায় গোড়া হইতে ডাক পড়িলে পরের দফায় শেষ হইতে রাজ্যগুলিকে ডাকা হয়। অথবা, লটারির মাধ্যমে ডাকিবার প্রথাও চালু করিবার দাবি পেশ করা যাইত। সেই পরিবর্তন অনেক সহজ হইত। রাজ্যের নাম পাল্টাইয়া ফেলিবার সিদ্ধান্তে ইতিহাসবোধের যে অভাব প্রকট হইল, ডাকিবার পদ্ধতি পরিবর্তনে রাজ্য সরকার সেই দোষে দুষ্ট হইত না। বাংলাদেশের আপত্তিটিও জরুরি— যে নামে ইতিমধ্যেই একটি সার্বভৌম দেশ আছে, ভারতের একটি খণ্ডরাজ্যের সেই নাম রাখিয়া খামকা বিভ্রান্তি বাড়াইবার প্রয়োজন কী ছিল?

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনে একটি রাজনৈতিক দল ঘোর আপত্তি জানাইয়াছে। তাহার নাম ভারতীয় জনতা পার্টি। বিজেপির মতে, ‘পশ্চিমবঙ্গ‌’ নামটি বাতিল করিয়া দিলে দেশভাগের ইতিহাসও মুছিয়া যায়। আনন্দবাজার পত্রিকা-র আপত্তিও ইতিহাস মুছিয়া ফেলাতেই। কিন্তু, বিজেপির আপত্তির সহিত সেই আপত্তির ফারাক এমনই মূলগত যে তাহা স্পষ্ট করিয়া বলা প্রয়োজন। ফারাক ইতিহাসবোধে, ইতিহাসের ব্যাখ্যায়। বিজেপির নিকট দেশভাগ একটি পরাজয়ের মুহূর্ত— ‘অখণ্ড ভারত’ নামক কল্পনাটি হইতে মুসলমানদের জমি ছাড়িতে বাধ্য হওয়ার পরাজয়। এবং, ইতিহাস তাহাদের নিকট বর্তমানের লড়াই লড়িবার আয়ুধ। দেশভাগের সংলগ্ন যন্ত্রণার স্মৃতিকে— অবশ্যই সাম্প্রদায়িক সংঘাতের স্মৃতিকে— বর্তমান রাজনীতির পরিসরে ব্যবহার করা বিজেপির রণকৌশল। ২০১৯-এ এই রাজ্য হইতে ২২টি আসন চাহেন, জানাইয়া দিয়াছেন অমিত শাহ। বর্তমানের জোরে যদি লড়াই সম্ভব না হয়, দেশভাগের অতীতকে হাতিয়ার করিতে বিজেপির বাধিবে না বলিয়াই আশঙ্কা হয়। ফলে, কেন বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনে আপত্তি করিতেছে, এবং সেই আপত্তি কতখানি বিপজ্জনক, স্পষ্ট বুঝিয়া লওয়া দরকার।

ইতিহাসকে অস্বীকার করিবার চেষ্টায় আমাদের আপত্তির কারণ ভিন্ন। দেশভাগ ইতিহাসের সূচনালগ্ন নহে। সেই ঘটনা অতি যন্ত্রণার, কিন্তু বাংলার বহমান ইতিহাসে তাহা একটি মুহূর্তমাত্র। পশ্চিমবঙ্গ নামটির মধ্যে বাংলার সেই ইতিহাসটি ধরা ছিল। একদা অভিন্নতার, পরে বিচ্ছেদের। এবং, বিচ্ছিন্ন হইবার পরেও যে বাঙালির অস্তিত্ব খণ্ডিত নহে, বরং তাহার একটি ভিন্ন জাতিসত্তা আছে, যাহা দেশের রাজনৈতিক পরিধিতে সীমাবদ্ধ নহে, ‘পশ্চিম’ শব্দটির মধ্যে সেই বোধ ছিল। এই বোধটিই ইতিহাসের বোধ। তাহাতে ফের একত্র হইবার দাবি নাই, অথবা কোনও অন্যায়ের শিকার হইবার বোধও নাই। কিন্তু, নাম পাল্টাইয়া ফেলিলে এই জাতিসত্তার বোধটিকে অস্বীকার করা হয়। যেমন, পশ্চিমবঙ্গ নামক ৭১ বৎসরের অস্তিত্বটির জঙ্গম ইতিহাসকেও অস্বীকার করা হয়। এতখানি ইতিহাস মুছিয়া ফেলিবার কোনও প্রয়োজন ছিল না।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন