ভুশণ্ডীর মাঠে গত কয়েক দিন ধরে ব্যাপক হট্টগোল। শিবু, নৃত্যকালী, কারিয়া পিরেতরা ছিলই, হাল আমলে তার সঙ্গে আরও জুটেছে সাম্প্রদায়িকতার ভূত, অসহিষ্ণুতার ভূত, জাতীয়তাবাদী ভূত ইত্যাদি। সব মিলিয়ে জনবিস্ফোরণের মতো সেখানে এখন প্রায় ভূত-বিস্ফোরণ!
পরশুরাম যে রকম বাতলে গিয়েছেন, ভুশণ্ডীর মাঠে সেই ভাবেই যেতে হয়। রিষড়া, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটীর হাট, চাঁপদানির চটকল ছাড়িয়ে আরও দু’তিন ক্রোশ। এখন অনেক আলো, বহুতল বাড়ি, শপিং মল, সব মিলিয়ে জায়গাটা বদলে গিয়েছে। কিন্তু চোখ থাকলেই ভুশণ্ডী পৌঁছে যাওয়া যায়।
প্রথমেই দেখলাম যুদ্ধবাজ ভূতকে। ইয়া বিশাল ছাতি, ভাঁটার মতো চোখ নিয়ে সে বলছে, ‘‘উচিত শিক্ষা দিতে হবে।’’ সব ভূতেরা সেই কথায় তুমুল করতালি দিচ্ছে। কিছু দুষ্টু লোক যুদ্ধের প্রতিবাদ করে বলছে, ‘‘তখন তো আমাদেরই মুশকিল। সারা দেশটা ভুশণ্ডীর মাঠ হয়ে যাবে। তখন আমার শ্যাওড়া গাছটা কোথায় খুঁজে পাব? বা ওর বেলগাছটা?’’ তারা এই সব প্রশ্ন করলেই জনাকয়েক হোঁৎকা ও শুঁটকো ভূত ছুটে গিয়ে চড়চাপাটি দিচ্ছে। ভূতসমাজে এখন এটাই নিয়ম। সকলকে এক সুরে গাইতে হবে, কোনও মতান্তর নয়।
আরও পড়ুন: ফাগুন রাতে পাত্র ধরতে তেপান্তর মাপল পুলিশ
যুদ্ধবাজ ভূতের ভাষণ চলতে চলতেই তিনি এলেন। শ্বেত শ্মশ্রুগুম্ফমণ্ডিত জোব্বা-পরা ভূত। শুনলাম, তিনি এখানকার বাসিন্দা নন। কয়েকশো আলোকবর্ষ দূরে কোথাও একটা থাকেন। যুদ্ধবাজ ও জাতীয়তাবাদী ভূতেরা তাঁকে ছুটে গিয়ে প্রণাম করল, ‘‘এত দিনে এলেন!’’
জোব্বা বললেন, ‘‘মায়া কাটাতে না পেরে মাঝে মাঝে পেনেটিতে ঘুরে যাই। ছেলেবেলার স্মৃতি তো! সেখান থেকেই তোমাদের হট্টগোল কানে এল।’’
‘‘হট্টগোল?’’ জাতীয়তাবাদী ভূত বললে, ‘‘আপনি আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের স্রষ্টা। কষ্ট পাবেন জেনেও বলছি, দেশ জুড়ে অ্যান্টিন্যাশনালরা ঘুরছে, যুদ্ধের বিরোধিতা করছে। এটা মানা যায়?’’
জোব্বা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেন, ‘‘সে তো ভাল। জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করছে মানেই ওরা ভূত হয়নি, এখনও জীবনের আশা আছে।’’
জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা মানে জীবনের আশা? পিছন থেকে এক শুঁটকো ভূত ফোড়ন কাটল, ‘‘আরবান নকশাল।’’ জোব্বা তার দিকে এক বার তাকাতেই সে থতমত খেয়ে চুপ। জোব্বা তার পর বললেন, ‘‘ভূতপূর্ব জীবনে গীতাঞ্জলি, জনগণমন লেখার আগে ১৯০৮ সালে ‘পথ ও পাথেয়’ নামে একটা প্রবন্ধে লিখেছিলাম, ‘আমি যাহা করিব সকলকেই তাহা করিতেই হইবে, আমি যাহা বলিব, সকলকে তাহা বলিতেই হইবে এইরূপ বলপ্রয়োগে দেশের সমস্ত মত, ইচ্ছা ও আচরণ-বৈচিত্রের অপঘাতমৃত্যুর দ্বারা পঞ্চত্বলাভকেই আমরা জাতীয় ঐক্য স্থির করিয়া বসিয়া আছি।’’’ তার পর একটু থেমে হাসলেন, ‘‘ভাল। ভুশণ্ডীর মাঠে তো পঞ্চত্বপ্রাপ্তির সাধনাই হবে। মানুষরা এ সব পড়ে, তোমরা ভূতেরা তো আর পড়বে না।’’
একটু দূরে এক চেনা ভূত গজগজ করতে করতে বলল, ‘‘হুঁ, ১৯০৮। আরে বাবা, একশো দশ বছর কেটে গিয়েছে, লোকে এখন আমার লেখাই বেশি পড়ে।’’ বাতুলটাকে এত ক্ষণ পরে চেনা গেল। গোঁগোঁঁ! চন্ডুখোর ভূত, পেশায় লেখক ও সম্পাদক। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর গল্পে এই মহাপ্রভুর কথা লিখে গিয়েছেন, ‘‘সকল সংবাদপত্র অফিসেই তাঁর অদৃশ্যভাবে যাতায়াত আছে। ভূতগ্রস্ত হইয়া লেখকরা কত কি যে লিখিয়া ফেলেন!’’ পুরনো পরিচিতির রেশ টেনে গোঁগোঁঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলাম, অভদ্রের মতো আমাকে তাড়িয়ে দিল, ‘‘কেটে পড়ো। আমার এখন অনেক কাজ।’’ জিজ্ঞেস করলাম, আবার কাগজের অফিসে যাবে? গোঁগোঁ বলল, ‘‘ধ্যাৎ, এখন অনেক সোশ্যাল সাইট আছে। আমি ঘাড়ে চাপলে সবাই একের পর এক ফেক নিউজ় লিখতে থাকে। যুদ্ধের বাজার, বোঝো না?’’
চেনা-অচেনা কত ভূতকে যে দেখলাম! সিড়িঙ্গেপানা এক লম্বা ভূত জলের ওপর দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে নিজের বাঁ হাতটা খুলে তরোয়ালের মতো ঘোরাতে লাগল। এ তো নিধিরাম! শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের চেনা, বুরুন অঙ্কে তেরো পাওযার পর এসেছিল। তার পর যা অঙ্ক কষে দিয়েছিল, ক্রিকেটে পর পর ছক্কা মেরেছিল, সবাই জানে। নিধিরামও এখন গোঁসাইবাগান ছেড়ে এখানে! নিধি বলল, হোয়াটসঅ্যাপের ভূত তার জীবন জেরবার করে ছেড়েছে। বুরুনরা এখন আর অঙ্কে তেরো পায় না। মাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা-ইংরেজি-ইতিহাস-অঙ্ক সব পরীক্ষার প্রশ্নই নাকি হোয়াটসঅ্যাপের ভূত আজকাল চটপট দিকে দিকে ছড়িয়ে দেয়। জিজ্ঞেস করলাম, তাঁকে কি দেখা যায়? নিধি খ্যাঁক করে উঠল, ‘‘তোমার যেমন বুদ্ধি! ও কি আমার মতো জলে হেঁটে তোমায় ভয় দেখাবে না কি? ও হল নতুন প্রজন্মের ডিজিটাল ভূত, কোন মোবাইলে সেঁধিয়ে আছে, টেরটিও পাবে না।’’
ভুশণ্ডীর খবর, নব্যভূতেরা নাকি এই রকম। কোথায় সেঁধিয়ে, কখন কাকে আক্রমণ করবে বোঝা দায়। খোনা গলার মেছো ভূতের আর রমরমা নেই, বেশির ভাগই নিরামিষাশী। সেই যে উপেন্দ্রকিশোর লিখেছিলেন না, ‘তেল হ্যায়, ইম্লী হ্যায়’, এখন অনেকে সে রকমই খাওয়াদাওয়া করে। নিরামিষাশী ভূতেরা নাকি ভুশণ্ডীর মাঠে স্কুলের মিড ডে মিল থেকে ডিমও উঠিয়ে দিচ্ছে। মড়ার মাংস বা ‘চ্যাং ব্যাং শুঁট্কি হ্যায়’ গোছের সুস্বাদু খাবারও তারা আর খায় না। শুধুই তৃণভোজী গোভূতের রমরমা।
সাম্প্রদায়িকতার ভূত এ রকমই নতুন প্রজন্মের। আগে ভুশণ্ডীর মাঠে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ ছিল, মামদো থেকে ব্রহ্মদৈত্য সবাই একসঙ্গে থাকত। এখন সাম্প্রদায়িকতার ভূতের জ্বালায় সবাই তটস্থ, পরিচিত ভূত লুল্লু এসে বলল, ‘‘দেখেছ, মেরে আমার কী হাল বানিয়েছে। ত্রৈলোক্যনাথ বরং আমার গল্পটা না লিখলেই পারতেন।’’ আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন, কে মারল? আর, ত্রৈলোক্যনাথ লিখেছেন বলেই তো তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হল। লুল্লু বলল, ‘‘সে অন্য যুগ রে ভাই। ওই যে উনি লিখেছেন, দিল্লি শহরের মুসলমান আমিরের বৌকে আমি উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম, তাতেই সর্বনাশ হল।’’ শুনলাম, মামদোকে এক দিন সবাই গণপ্রহার দিতে গেলে লুল্লু তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। সাম্প্রদায়িকতার ভূতেরা তখন তাকে ‘‘এই তুই আমিরের বৌকে নিয়ে গিয়েছিলি না? মুসলমান প্রেম? লাভ জিহাদ চলবে না’’ বলে উত্তম মধ্যম দিয়েছে।
এ তো নতুন ভূত! অবাক হলাম। লুল্লু, নিধিরাম, সবাই সমস্বরে জানাল, ‘‘তাও তো আসলটার কথা শোনোনি। ক্ষমতার ভূত! বরাবরই ছিল, এখন আরও ডেঞ্জারাস। এই লুল্লুকে যারা পিটিয়েছিল, সেই অসহিষ্ণু ভূত আর ক্ষমতার ভূত বরাবর হাত ধরাধরি করে চলে।’’ ভুল করে জিজ্ঞেস করলাম, রাম-লক্ষ্মণের মতো? সবাই চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘এই, মাঝরাত্তিরে ও সব আজেবাজে কথা বলবে না।’’
ক্ষমা-টমা চেয়ে, ভূতেদের তুষ্ট করে জানা গেল, ক্ষমতার ভূত অনেকটা ইংরেজি ড্রাকুলার মতো, কখন কোত্থেকে কার ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে দেবে ঠিক নেই। একদা কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে লেনিনের শেষ কয়েকটি দিন নিয়ে ‘টরাস’ নামে একটা ছবি দেখানো হয়েছিল। সবাই রে রে করলেও পাকা চুলের সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক সেটি মানেননি, ছবি দেখানো হয়েছিল। কয়েক বছর পরে তাঁর ঘাড়েই হঠাৎ ক্ষমতার ভূত নিঃশব্দে লাফিয়ে পড়ল, নন্দন থেকে ‘হারবার্ট’ ও ‘হ্যাংম্যান’ তুলে দিলেন। লুল্লু বলল, ‘‘ক্ষমতার ভূত কি আর এক জায়গায় থাকে? ভূতের রাজার বরে ও যেখানে সেখানে যেতে পারে। হাতে তালি দেওয়ার দরকার হয় না। আজ দেখলে রাজস্থানে করণী সেনার ঘাড়ে, পরশু পশ্চিমবঙ্গে কারও ঘাড়ে। নারীপুরুষ নির্বিশেষে, কাউকে ছাড় দেয় না।’’
তা হলে সে-ই কি এখন সবচেয়ে সাংঘাতিক ভূত? লুল্লু বলল, ‘‘হতে পারে। ওই ভূতের আক্রমণে অনেককে বোবায় ধরে। ধরো, ক্ষমতার ভূত কারও নাটক বা সিনেমা নিয়ে ঝামেলা করেছিল। দ্বিতীয় বার তারা আর ট্যাঁ-ফোঁ করবে না।’’ নিধিরাম বলল, ‘‘তবে একটা ব্যাপারে সাবধান থেকো বাপু। ক্ষমতার ভূত কখনও বেলগাছে বা শ্যাওড়া গাছে থাকে না। আজকাল সিনেমার পর্দাতেই তার দাপাদাপি বেশি।’’
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য