নরেন্দ্র মোদী
নরেন্দ্র মোদী বিলক্ষণ অবাক হইবেন। না-হয় জিয়ো ইনস্টিটিউটের অস্তিত্ব নাই, না-হয় তাহার ওয়েবসাইটও তৈরি হয় নাই। কিন্তু, এই অতি সামান্য কারণে তাহাকে ‘ইনস্টিটিউট অব এমিনেন্স’ বা ‘গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’-এর তকমাও দেওয়া যাইবে না? কিছুর মাহাত্ম্য স্বীকার করিতে হইলে তাহার অস্তিত্ব থাকিতেই হইবে? বর্তমান ভারত, মোদীজির ভারত এমন বিচিত্র বিশ্বাস পোষণ করে না কি? ঘটনা হইল, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পূর্বে এবং পরে নরেন্দ্র মোদী যত গল্প শুনাইয়াছেন, যত স্বীকৃতি দিয়াছেন এবং যত স্বীকৃতির দাবি করিয়াছেন, তাহার অধিকাংশই নিতান্ত বায়বীয়। ২০১৪ সালে দেশের অন্তত ৩১ শতাংশ মানুষ যে ‘অচ্ছে দিন’-এর মাহাত্ম্যে গলিয়া গেল, তাহাকে কি আজ অবধি কেহ চক্ষে দেখিয়াছে? পাঁচ বছরে কৃষকের আয় দ্বিগুণ হইবে, এমন আষাঢ়ে গল্পও নরেন্দ্রভূমিতে সরকারি নীতি হিসাবে কীর্তিত হইতেছে। মিনিমাম গভর্নমেন্ট মানে যে সর্বগ্রাসী সরকার, তাহাই বা কে কবে জানিত? ‘এনটায়ার পলিটিকাল সায়েন্স’-এ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরের ডিগ্রি পাইবার ব্যবস্থা আছে কি না, ভক্তরা অবশ্যই সেই প্রশ্ন করেন নাই। করিবেনই বা কেন? যাহার অস্তিত্ব নাই, অথবা যাহার অস্তিত্ব প্রমাণের কোনও উপায় নাই, নরেন্দ্র মোদীর জমানায় তাহারই মাহাত্ম্য। জিয়ো ইনস্টিটিউটের স্বীকৃতি সেই ধারাটিই বজায় রাখিয়াছে। দেশবাসী এত দিন সোনা মুখ করিয়া গল্পগাছা শুনিয়া আসিল। আর আজ অনস্তিত্বশীল জিয়ো ইনস্টিটিউট বা বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তকমা দিলে এত হইচই? দেশের মানুষ যদি দিনে হয় একমত, রাতে হয় আর, তবে প্রধানমন্ত্রী যাইবেন কোথায়?
তবে কিনা, হাওয়ায় কোনও কেল্লাই অকারণে নির্মিত হয় নাই। ‘অচ্ছে দিন’-এর গল্প কেন প্রয়োজন ছিল, তাহার ব্যাখ্যা অপ্রয়োজনীয়। জিয়ো ইনস্টিটিউটকে কেন ‘গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’-এর তকমা দেওয়া হইল? দুর্জনে বলিবে, বন্ধুকৃত্য। কিন্তু, তাহার চরিত্রটি কী? এই স্বীকৃতির জন্য দশটি সরকারি ও দশটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাছিয়া লওয়ার কথা ছিল। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক জিয়ো ইনস্টিটিউট সমেত মোট ছয়টি প্রতিষ্ঠান খুঁজিয়া পাইয়াছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি সরকারি অর্থসাহায্য পাইবে না, মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক তড়িঘড়ি জানাইয়াছে। তাহার প্রয়োজনও নাই। কারণ, এই স্বীকৃতির মাহাত্ম্য অর্থসাহায্যে নহে, বরং সরকারি নিয়ন্ত্রণ হইতে মুক্তিতে। যে নিয়ন্ত্রণ কালেক্রমে আরও বাড়িবে বলিয়াই আশঙ্কা করা চলে।
যাদবপুর বা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় প্রতিষ্ঠানগুলি যখন প্রতি পদে সরকারি বাধার সম্মুখীন হইবে, প্রতি ধাপে অর্থের অভাবে ভুগিবে, তখন ‘গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’গুলি বাজার হইতে ইচ্ছামতো টাকা তুলিতে পারিবে, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত যৌথ উদ্যোগে যাইতে পারিবে, নির্দ্বিধায় বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ করিতে পারিবে। অর্থাৎ, সরকারি অর্থসাহায্য ব্যতীতই তাহারা বাজারের প্রতিযোগিতায় বহু ধাপ আগাইয়া থাকিবে। দেশের আর সকল সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ কি বার্তাটি পড়িয়া লইতে পারিবেন না যে ছাত্র ও শিক্ষকদের যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যদি পাঠশালা হইতে হীরকরাজাকে প্রশ্ন করিবার দুঃসাহস দেখা না যায়, তবে ডানা মেলিবার এমন সুযোগ মিলিতেও পারে? সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিক মুকেশ অম্বানী নহেন। হইবার প্রয়োজনও নাই। মূল কথা যে বশ্যতা স্বীকার করিয়া লওয়া, তাহা কি সরকার স্পষ্ট করিয়া দিল না? সরকারের ভাল খাতায় নাম লিখাইবার জন্য হুড়াহুড়ি পড়িয়া যাইবে, আঁচ করা চলে। তাহার অধিক কি কিছু চাহিবার থাকিতে পারে?