এই প্রতারক স্বাধীনতার প্রতিবাদ

কারণটা অবশ্য আমাদের খেয়াল করিয়ে দেন শঙ্খ ঘোষ। গত বারের পুজোতেই একটি নিবন্ধে তিনি লিখলেন, ‘‘রোজই আমাদের পড়ার মধ্য দিয়ে, আমাদের বোধের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন জন্ম হতে পারে রবীন্দ্রনাথের।’’

Advertisement

শিলাদিত্য সেন

শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০৭
Share:

আশ্বিন-কার্তিকেই গল্পটা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এমনই এক শরৎ-হেমন্তের সন্ধিক্ষণে। পড়তে-পড়তে আর খেয়াল থাকে না— গল্পটা তখনকার, না এখনকার— হয়তো দুই সময়েরই। রবীন্দ্র-তন্নিষ্ঠ এমন পাঠক পাওয়া শক্ত যিনি ‘মেঘ ও রৌদ্র’ (১৩০১) পড়েননি, তবু কেন-জানি না বারে বারে ফিরে পড়তেই হয় গল্পটা।

Advertisement

কারণটা অবশ্য আমাদের খেয়াল করিয়ে দেন শঙ্খ ঘোষ। গত বারের পুজোতেই একটি নিবন্ধে তিনি লিখলেন, ‘‘রোজই আমাদের পড়ার মধ্য দিয়ে, আমাদের বোধের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন জন্ম হতে পারে রবীন্দ্রনাথের।’’ তাঁর গল্পগুলির ভিতর দিয়ে সেই পরাধীন ভারতবর্ষ উঠে আসে প্রতিনিয়ত, যেখানে এ দেশের বাসিন্দাদের অস্তিত্ব ছিল উপনিবেশের নিয়মে বাঁধা। এ দেশের মানুষের প্রতি, বিশেষত স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের প্রতি ব্রিটিশশাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থার ঔদাসীন্য এমন এক নিষ্ঠুর শীতল পরিমণ্ডল তৈরি করে রাখত, যাতে সেই নাগরিকেরা, ব্যক্তিমানুষেরা আস্তে আস্তে কোণঠাসা হয়ে পড়তেন সমাজে। যেমন, ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পের নিঃসঙ্গ শশিভূষণ। ভাবনায় ভিন্ন, স্বভাবে স্বতন্ত্র, প্রতিবাদে বিশ্বাসী মানুষটির গতি হয়েছিল কারাবাসে। পাঁচ বছরের জেল খাটতে যাওয়ার আগে তাঁর পিতা যখন তাঁকে নির্দোষ প্রমাণের জন্যে আদালতে মামলায় উদ্যত হলেন, শশিভূষণ তাঁর পিতাকে নিষেধ করে বললেন, ‘‘জেল ভালো। লোহার বেড়ি মিথ্যা বলে না, কিন্তু জেলের বাহিরে যে স্বাধীনতা আছে সে আমাদিগকে প্রতারণা করিয়া বিপদে ফেলে।’’

শশিভূষণের অমোঘ মন্তব্যটি স্বাধীনতার সত্তর বছর পরে কি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক? উপনিবেশের সমাজ থেকে আজকের স্বাধীন ভারতের সমাজের খুব একটা তফাত আছে কি? প্রতারক স্বাধীনতা, প্রতারক সমাজই তো প্রতি মুহূর্তে আমাদের পিছনে টেনে নিয়ে চলেছে। ভিন্নতা-অভিলাষী যে কোনও ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকেই আমাদের সরকার এক আরোপিত ঔদাসীন্যে বিচ্ছিন্ন করে রাখে, কোণঠাসা করে রাখে সমাজও, যাতে চালু ব্যবস্থা বা সিস্টেম-এর কোনও ব্যত্যয় না ঘটে। আর আমরা অধিকাংশই এই ব্যবস্থাটাকে মানিয়ে নিই, মানিয়ে চলি, খেয়ালও রাখি না যে এ ব্যবস্থাটা কারও কারও কাছে অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। গরিষ্ঠতার গর্বে এতটাই আত্মতৃপ্ত থাকি যে ভিন্ন মন বা মতের মানুষটিকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনি না।

Advertisement

গত ৬ সেপ্টেম্বর সমকামিতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে প্রচুর উচ্ছ্বাসের পর ফের সেটা টের পাওয়া গেল। অনেকের মুখ-বাঁকানো পরিহাসে, সোশ্যাল মিডিয়ার একের পর এক কদর্য ঠাট্টায়। প্রকট হয়ে এল কোন প্রতারক স্বাধীনতায় আমরা বাঁচি, আর সে স্বাধীনতার ধারক-বাহক সমাজটিই বা কতখানি পিছিয়ে চলেছে আমাদের। বহু কাল ধরেই এ দেশে সমকামিতার সম্পর্ককে অস্বীকার কিংবা আক্রমণ করা হয়ে আসছে।

সরকার আর সমাজকে প্রায় তিরস্কার করেই রায় দিয়েছে শীর্ষ আদালত, বলেছে, ব্যক্তির ইচ্ছাকে সম্মান করাই গণতন্ত্র বজায় রাখার মূল চাবিকাঠি, ভিন্নতাকে (তা সে যতই প্রান্তিক পরিসরের হোক না কেন) স্বীকৃতি দেওয়াই সংবিধানের নৈতিকতা। এই সাংবিধানিক নৈতিকতা তুলে ধরাই দেশের সরকারের কাজ, আর সমাজের কাজ হল তার লালনপালন। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘‘আমি যা, আমি তা-ই। আমাকে সে ভাবেই গ্রহণ করতে হবে।’’ বেঞ্চের অন্যতম বিচারপতি বলেছেন, ‘‘বছরের পর বছর সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য এলজিবিটি সম্প্রদায়ের কাছে ইতিহাসের ক্ষমাপ্রার্থনার দায় থেকে যায়।’’

অথচ সে দায় সব চেয়ে বেশি অস্বীকার করে, কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয় সমাজই। ব্রিটিশশাসনের মতোই ভিন্ন বাঁচায় বিশ্বাসী কোনও ব্যক্তির সম্পর্কগুলিকে ক্রমাগত ‘অযৌক্তিক’ আর ‘অসঙ্গত’ বলে চিহ্নিত করে, পাশাপাশি সরকারও সুর মিলিয়ে বলে চলে— এ সমস্তই সমাজের শৃঙ্খলার পক্ষে হানিকর, বিপজ্জনক। সরকার বা সমাজ, দুই-ই ব্যক্তির নিজের মতো বাঁচাকে মানতে চায় না, স্বেচ্ছাচারিতা মনে করে, ফলে সমকামিতাও এই সব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার চোখে ‘স্বাভাবিক’ যৌনতা নয়, ‘স্বেচ্ছাচারী’ যৌনতা।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে, বছর দেড়েক ধরে যে ফরাসি ছবিটি নিয়ে সারা দুনিয়া তোলপাড়, সেটির কথা। ২০১৭ সালের সেই ‘ওয়ান টোয়েন্টি বিটস পার মিনিট’ দেখেছিলাম গত শীতে গোয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসব ‘ইফি’তে। এখন দেখলে মনে হবে যেন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানানোর জন্যেই তা মঞ্চ প্রস্তুত করছিল। এমন ভিন্নতাপন্থী ব্যক্তিবর্গ, সমাজ-সরকারের মুখোমুখি রুখে দাঁড়ানোর সাহসের কথাই বলা হয়েছে রব্যাঁ কাঁপিয়ো-র এই ছবিটিতে। উন্নতিকামী ভারতীয় সমাজের সঙ্গে ইউরোপের উন্নত ফরাসি সমাজের বহু অমিল থাকা সত্ত্বেও একটি ব্যাপারে আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব এই ছবিটির ভিতর— চালু রাস্তায় পা না-বাড়ানো ব্যক্তির উপর সরকার আর সমাজের নির্মম আক্রমণ, কিংবা নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যের মধ্যে।

মরক্কোয় জন্ম, ছাপ্পান্ন বছর বয়সি রব্যাঁ নিজেও এক জন সমকামী। প্যারিসে সমকামীদের আত্মরক্ষার সংগঠন ‘অ্যাক্ট আপ’-এর সদস্য হিসাবেই তিনি তাঁর ছবিতে নব্বই দশকের গোড়ায় ওই সংগঠনের প্রতিবাদের চেহারাটা তুলে এনেছেন। কেন এই প্রতিবাদ? কেননা, তাঁদেরকে ‘এড্‌স কমিউনিটি’ আখ্যা দিয়ে একঘরে করে ফেলা হত। তাঁদের মধ্যে যাঁরা ‘এইচআইভি পজিটিভ’, তাঁদেরকে উপযুক্ত চিকিৎসা করা দূরে থাক, ন্যূনতম শুশ্রূষারও বন্দোবস্ত করা হত না, রাস্তায় ফেলে রাখা হত তাঁদের রুগ্‌ণ মৃতদেহ। সরকারি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির চরম ঔদাসীন্য ছিল তাঁদের প্রতি, উল্টো দিকে তাঁদের প্রতিবাদ ছিল সম্পূর্ণত নিরস্ত্র। হানা দিতেন সরকারের স্বাস্থ্য দফতর-সহ আরও নানান বিভাগে, ওষুধের কোম্পানিগুলিতে। সেই সমবেত প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে তাঁদের হাতে থাকত প্ল্যাকার্ড, কৃত্রিম রক্ত ও শুক্রাণু, আর এড্‌স-আক্রান্ত মৃত বন্ধুদের পোড়ানোর ছাই।

না, কোনও পিরিয়ড ফিল্ম বানানোর কথা ভেবে এ ছবি করেননি রব্যাঁ, এমনকি দর্শককে স্মৃতিজনিত নস্টালজিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ছবিও এটা নয়। এখনও এই মুহূর্তেও যে লড়াইটা জারি আছে, সেটাই সকলকে মনে করিয়ে দিতে এই ছবি: ‘‘আই জাস্ট ওয়ান্ট পিপল টু গেট কানেক্টেড টু দিস হিস্ট্রি... টু কনভিন্স পিপল পলিটিক্যালি।’’ তাঁর কাছে এই ছবি হল আমাদের প্রতারক স্বাধীনতার চেহারাটা চেনানোর একটা পথ মাত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন