সম্পাদকীয় ১

গৌরবের দায়

পরিচালক মহাশয় বলিতে পারেন, তিনি শিল্পের খাতিরে গল্প বলিয়াছেন, কোনও ‘বার্তা’ দেওয়া তো তাঁহার লক্ষ্য নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:১০
Share:

পদ্মাবত লইয়া বালখিল্যসুলভ বাড়াবাড়ি যখন সীমা ছাড়াইতেছে, তেমন সময় স্বরা ভাস্কর একটি অতি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলিলেন। কেন ‘জহরব্রত’ নামক প্রথাটিকে এই চলচ্চিত্রে এতখানি গৌরবময়তা দেওয়া হইল, জানিতে চাহিয়া তিনি পরিচালক সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনিলেন যে, তিনি নারীর পক্ষে অবমাননাকর চিন্তাভাবনাকে উসকানি দিতেছেন। কৃতী অভিনেত্রী স্বরা ভাস্করের ‘খোলা চিঠি’টি ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়িয়া দৃশ্যমান। নিন্দুকরা বলিতেছেন, স্বরার বক্তব্যের একটি পঙ্‌ক্তি, অর্থাৎ এই সিনেমা নারীকে যোনিসর্বস্ব বলিয়া দেখাইবার বন্দোবস্ত— তাহাই নাকি জনপ্রিয়তার বান ডাকিবার কারণ! সে যাহাই হউক, স্বরার চিঠির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভন্সালী নিশ্চয় বুঝিতেছেন যে এই সমালোচনার সারমর্ম এড়াইয়া যাওয়া তাঁহার পক্ষে কঠিন। পদ্মাবতীর কাহিনি (বা ইতিহাস) বলে, আক্রান্ত হইবার ভয়ে রাজপুত মহিলারা অগ্নিবরণ করিয়াছিলেন, যাহার পোশাকি নাম জহরব্রত। সুলতানি আমলের এই গল্পকে আজ হঠাৎ করিয়া তুলিয়া আনিলে যে পরোক্ষে নারীর যৌন বিশুদ্ধতার প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া হয়, এবং সেই বিশুদ্ধতা নষ্ট হইলে আত্মধ্বংসে প্রবৃত্ত হওয়াকে সমর্থন করা হয়: এই অভিযোগের উপযুক্ত উত্তর ভন্সালী দিতেই পারেন, কিন্তু অভিযোগটি ফেলিয়া দিতে পারেন না। বর্তমান ভারতে নারীর প্রতি আক্রমণ ও অত্যাচার প্রতি দিন বাড়িতেছে। নারীসমাজও সেই আক্রমণ-আধিক্য লইয়া বিপর্যস্ত, বিভ্রান্ত বোধ করিতেছে। এই সময়ে এমন এক বার্তা সমাজে প্রেরিত হইলে তাহার বিপদের সম্ভাবনা ভন্সালীরা এড়াইয়া যাইতে পারেন না।

Advertisement

পরিচালক মহাশয় বলিতে পারেন, তিনি শিল্পের খাতিরে গল্প বলিয়াছেন, কোনও ‘বার্তা’ দেওয়া তো তাঁহার লক্ষ্য নয়। শিল্পীর কাজ কি তবে কেবল সমাজের প্রতি বার্তা দেওয়া? মনোরম পুরাকাহিনি, উপকথা-রূপকথার দুনিয়া হইতে শিল্পী কি তবে স্বেচ্ছা-নির্বাসন লইবেন, যাহাতে প্রাচীন দেশকালের সূত্রে বর্তমান সমাজে কোনও ভ্রান্ত বার্তা না যায়? রাজা (কিংবা পেশোয়ার) একাধিক স্ত্রী-র কাহিনি বর্ণনা করিলে কি তবে বহুবিবাহকে উসকানি দেওয়া হইবে? মুসলিম দস্যুর কথা লিখিলে বঙ্কিমচন্দ্র কি মুসলিম-বিদ্বেষী হইয়া যাইবেন? অবনীন্দ্রনাথের ‘রাজকাহিনী’কে কি তবে রাজপুত বংশকৌলীন্যের জয়গান গাইবার জন্য নির্বাসন দেওয়া হইবে? মানিতেই হয়, শিল্পীর স্বাধীনতা অত্যন্ত জরুরি অধিকার। গণতান্ত্রিক সমাজে তাহা নাগরিকের বাক্‌স্বাধীনতার মতোই গুরুতর বিষয়।

প্রত্যুত্তরে একটি কথা হয়তো বলার থাকে। সব শিল্পমাধ্যমই যেহেতু এক গুরুত্বে অন্বিত নয়, সব পরিস্থিতিই যেহেতু একই মুক্তিতে উদ্ভাসিত নয়, সামাজিক প্রেক্ষিতটিকে তাই সম্পূর্ণ ফেলনা বলা যায় না। দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য বলা মুশকিল, জাতিধর্মবর্ণভাষাবৈচিত্রে অধ্যুষিত এই দেশে বলিউড কিন্তু সর্ব অর্থেই একটি অনন্য শিল্পমাধ্যম, এক বিশালাকার জনসমাজের কাছে প্রায় অদ্বিতীয় সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা। আ-কেরলকাশ্মীর তাহার প্রভাব, নারীপুরুষশিশুকিশোর নির্বিশেষে তাহার বিশ্বাসবিমুগ্ধ দর্শক। এই অতিরিক্ত গৌরবের কারণে তাহার কি একটি অতিরিক্ত দায়ও থাকিয়া যায় না? এই মুহূর্তে রাজস্থানের ক্ষত্রাণীরা শাসানি দিতেছেন যে সিনেমাটি ওই রাজ্যে প্রদর্শিত হইলে তাঁহারা প্রতিবাদে দলে দলে জহরব্রত পালন করিবেন। ভন্সালী কি নিশ্চিত যে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী জহর-গৌরব দেখাইয়া তিনি এই সংস্কারনিমজ্জিত পশ্চাদপরতাকে পরোক্ষ ইন্ধন জোগান নাই? সমাজের নৈতিক উত্তরণ ও অবনমনের দায়দায়িত্ব শিল্পী নিজের স্কন্ধে লইতে না চাইতেই পারেন। কিন্তু সেই প্রশ্ন যে শিল্প ও শিল্পীর পিছু ছাড়িবে না, বিশ্ব-ইতিহাস তাহার প্রমাণ।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন