ফের কি ফিরে এল ‘বঙ্গাল খেদা’

নেল্লির সেই রক্তস্নান করা রাত-দুপুরগুলো ফের যেন উঁকি দিচ্ছে, অসমে নাগরিক পঞ্জির হুঙ্কার এবং নতুন সন্ত্রাসের আবহে সেই স্মৃতি উস্কে দিলেন দেবর্ষি ভট্টাচার্য জাতীয় নাগরিক পঞ্জি প্রকাশ অসমে বসবাসকারী এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ভয়ঙ্কর অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) হল, ভারতবর্ষের কোনও অঙ্গরাজ্যে বসবাসকারী প্রকৃত নাগরিকদের খতিয়ানের তালিকা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৩১
Share:

জাতীয় নাগরিক পঞ্জি প্রকাশ অসমে বসবাসকারী এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ভয়ঙ্কর অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) হল, ভারতবর্ষের কোনও অঙ্গরাজ্যে বসবাসকারী প্রকৃত নাগরিকদের খতিয়ানের তালিকা। ১৯৫১ সালে ভারতবর্ষের প্রথম জনগণনা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অসমে জাতীয় নাগরিক পঞ্জির প্রথম তালিকা প্রকাশিত হয়। ৮০’র দশকের প্রথম দিকে, ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ তকমা দিয়ে অসম থেকে বাঙালি বিতাড়নের উদ্দেশ্যে এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি প্রকাশের দাবীতে, ‘আসু’ এবং ‘অগপ’র নেতৃত্বে সারা অসম জুড়ে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন শুরু হয়। পাশাপাশি ‘আলফা’র নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম অসম গঠনের দাবীতে সশস্ত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সবুজ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা বাঙালির রক্তে লাল ওঠে।

Advertisement

অবশেষে ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার, অসম সরকার এবং অসম আন্দোলনের নেতৃত্ব, এই তিন পক্ষের মধ্যে নয়াদিল্লিতে একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়, যা ‘অসম চুক্তি’ নামে পরিচিত। ত্রিপাক্ষিক এই চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল অসমের জাতীয় নাগরিক পঞ্জির প্রকাশ। এই ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে সে রাজ্যের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন তখনকার মতো স্তিমিত হলেও আজকের বহুচর্চিত জাতীয় নাগরিক পঞ্জির নবরূপ সেদিনের সেই চুক্তির মধ্যেই প্রোথিত হয়ে ছিল। সাম্প্রতিক অতীতে, ১৯৫৫ সালের ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের ওপর ভিত্তি করে এবং অসম চুক্তির শর্ত মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসারে এবং তত্বাবধানে অসমের জাতীয় নাগরিক পঞ্জির প্রকাশের প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত ১লা জানুয়ারী, ২০১৮ প্রকাশিত অসমের জাতীয় নাগরিক পঞ্জির প্রথম খসড়া তালিকায় মোট ৩.২৯ কোটি আবেদনকারীদের মধ্যে ১.৯ কোটি’র নাম বাদ পড়ে। গত ৩০শে জুলাই, ২০১৮ প্রকাশিত অসমের জাতীয় নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া তালিকায় প্রায় ২.৯ কোটি মানুষের নাম তালিকাভুক্ত হয় এবং ৪০.০৭ লক্ষ মানুষ এই তালিকা থেকে বাদ পড়েন। আগামী বছরে অসমের জাতীয় নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হওয়ার কথা। এই চূড়ান্ত তালিকায় যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত থাকবে না, তাঁদের নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য ট্রাইবুনাল, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ অবশ্য থাকবে, কিন্তু কোর্টের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।

অসমে বহিরাগত সমস্যার বিষয়টি বহুদিন থেকেই একটি চর্চিত বিষয় এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। অসমে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের থেকে অভিবাসিত অনেক মানুষজনের মধ্যে বহু বাঙালিও আছেন, একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু প্রশ্নটা হল, তাঁরা কি সবাই বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী? নাকি তাঁরা মানবসমাজের ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই অসমের ইতিহাসের একটি অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছেন? অসম রাজ্য, যাকে ‘অহম রাজ্য’ বলে অভিহিত করা হত, বর্তমান ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে পরিগনিত হলেও, তার নিজস্ব একটি ইতিহাসের মহীরুহ আছে।

Advertisement

১২২৮ সালে চীনের ইউনান প্রদেশের অন্তর্গত মং মাওয়ের রাজা, চাওলুং সুকাফা, হিমালয় পর্বতমালা অতিক্রম করে এসে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা দখল করেন এবং অসমে সুদীর্ঘ প্রায় ছয়’শো বছর অহম বংশের শাসনের সূচনা করেন। মোঘল রাজত্বকালেও এই অহম রাজ্য স্বশাসিত স্বাধীন রাজ্য হিসেবেই থেকে গিয়েছিল। ১৭৬৯ সালে অহম রাজার বিরুদ্ধে তীব্র ‘মোয়ামোরিয়া বিদ্রোহ’ সংগঠিত হয়, যার ফলস্বরূপ অহমের ক্ষমতা ক্রমশই দুর্বল হতে থাকে। ১৮০৫ সালে বর্মার সামরিক আগ্রাসনের কাছে পরাজিত হয়ে অহম রাজ্য বর্মার অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। এর পর ১৮২৪ সালে শুরু হয় প্রথম ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পরাজিত বর্মার রাজা ১৮২৬ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে ‘ইয়ানদাবোর চুক্তি’ করতে বাধ্য হন এবং ক্ষতিপূরণ স্বরূপ মনিপুর ও আরাকান-সহ গোটা অহম রাজ্য ব্রিটিশদের অধীনে তুলে দিতে বাধ্য হন। সেই থেকেই অসম ভারতের ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চলের মধ্যে চলে আসে। ব্রিটিশ শাসিত অসমের একেবারে শুরু থেকেই তাকে ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির’ আওতায় রাখার দরুন প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়ে অসমে বাঙালিদের অভিবাসন সেই সময় থেকেই শুরু হতে থাকে। এর পাশাপাশি সুচিকিৎসার স্বার্থে চিকিৎসকরা, শিক্ষা বিস্তারের স্বার্থে স্কুল-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-অধ্যাপকরা এবং জলে ডুবে থাকা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা চাষযোগ্য করে তোলার স্বার্থে চাষিরা বাংলা থেকে অসমে চলে আসতে শুরু করেন। আসামে চা-গাছের আবিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮২৮ সালের পরবর্তী সময়কালে চা বাগানের সূত্র ধরেও অসমে বাঙালি ও আদিবাসীদের অভিবাসন ঘটে। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন যখন বাংলা ভাগ করেন, তখন অসমকে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। এই সময়কালেও সাবেক পূর্ববঙ্গ থেকে প্রচুর বাঙালি অসমে চলে আসেন। ১৯১১ সালে দুই বাংলার হৃদয় আবার যখন জুড়ে যায়, তখন অসমকে একটি পৃথক প্রদেশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯১১ সালে ভারতে প্রথম জনগণনা করা হয়েছিল এবং ওই জনগণনার রিপোর্টেই অসমে তথাকথিত অভিবাসনের প্রশ্নটি উঠে এসেছিল। ভারত ভাগের পরবর্তী অধ্যায়ে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এবং অধুনা বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু বাঙালিরা যেমন পশ্চিমবঙ্গে এসে ঠাঁই নিয়েছেন, তেমনি বেশ কিছু বাঙালি উদ্বাস্তু অসমেও এসে থেকে গিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রয়োজনে এই অসহায় উদ্বাস্তু বাঙালিদের, শরণার্থী এবং অনুপ্রবেশকারী, এই দুই ভাগে ভাগ করে অসম থেকে বাঙালি বিতাড়নের চিত্রনাট্যের পটভূমিকা কিন্তু অনেক আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। তাই বারেবারে বাঙালী তাড়াও বা ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের খঞ্জরে বাঙালির রক্তে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মাটি ভিজে লাল হয়ে গেছে। গত ১লা নভেম্বর রাতে পাঁচ বঙ্গসন্তানকে ব্রহ্মপুত্র পাড়ে বসিয়ে গুলি করে নৃশংস হত্যালীলা সেই চিত্রনাট্যেরই সাম্প্রতিকতম নির্মম দৃশ্যায়ন। ‘বুড়া লুইতের’ বুকে এখনও চুঁইয়ে পড়ে ১৯৮৩ সালে সংগঠিত দাঙ্গায় নিহত হাজারো বঙ্গ সন্তানের রক্ত। ইতিহাসের শ্যাওলা পড়া দেওয়ালে আজও কিন্তু রক্তের অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে, “নেল্লি গণহত্যা স্বাধীনতার পরে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় গণহত্যা।”

এ হেন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে কৌতূহলী প্রশ্নটা হল, জাতীয় নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়া ‘রাষ্ট্রহীন মানুষদের’ ভবিষ্যৎ কী হবে? ‘রাষ্ট্রহীন মানুষদের’ জন্য ভারতবর্ষে কোন নির্দিষ্ট নীতি এখন পর্যন্ত নেই, কেননা এ ক্ষেত্রে ‘রাষ্ট্রহীন মানুষদের’ উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করা যাবে না। প্রথম সম্ভাব্য উপায় হতে পারে যে, এই সকল ‘রাষ্ট্রহীন মানুষদের’ ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়ন করা, যা কিনা কার্যত প্রায় অসম্ভব। কে নেবে এত বহুল সংখ্যক মানুষের দায়? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে এঁরা সবাই বাংলাদেশি, তা হলেও কি এত সংখ্যক মানুষকে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করা আদৌ সম্ভব? আর এই সকল মানুষদের কাছে বাংলাদেশি নাগরিকত্বের বৈধ কাগজ না থাকলে বাংলাদেশই বা কেন এত সংখ্যক মানুষের দায় নেবে? দ্বিতীয় সম্ভাব্য উপায় হতে পারে, ‘রাষ্ট্রহীন মানুষদের’ ভারতবর্ষের ‘ডিটেনশন ক্যাম্পে’ আটকে রাখা। কিন্তু সেটাও কি আদৌ বাস্তবে সম্ভব? অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের আটকে রাখার জন্য বর্তমানে অসমে ছ’টি ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ রয়েছে, এত সংখ্যক মানুষকে আটকে রাখার জন্য তা একেবারেই নগন্য। তা হলে একমাত্র উপায়টি হল, ভারতের নাগরিকরা সংবিধান প্রদত্ত যে সকল মৌলিক অধিকারের সুবিধা ভোগ করে থাকেন, এইসকল ‘রাষ্ট্রহীন মানুষদের’ থেকে সেই সব মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া। গত ৩রা জানুয়ারী আসামের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান যে, “যাঁরা জাতীয় নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়বেন, তাঁর সরকার সেই সব মানুষদের ভারতীয় সংবিধানের কোন মৌলিক অধিকার প্রদান করবে না।” যিনি প্রশাসনিক ক্ষমতার শিখরে এবং যার কাঁধে সংবিধান রক্ষার গুরুদায়িত্ব, তাঁর মুখে এমন অর্ধসত্য কিন্তু যথেষ্ট বিস্ময়ের অবকাশ রেখে যায় না!

শিক্ষক, এসআর ফতেপুরিয়া কলেজ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন