Babul Supriyo

মায়ের চলে যাওয়াটা সেই অঙ্কটা নিষ্ঠুর ভাবে মিলিয়ে দিয়ে গেল

অফিস থেকে ফিরে মায়ের হাতের চা আর মুড়ি-চানাচুর খেতে খেতে মেয়ের গলায় আধো আধো স্বরে মা-বাবার শেখানো ‘হাট্টিমাটিম টিম, তারা মাঠে পাড়ে ডিম’, ‘লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া’ বা ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ শুনতাম।

Advertisement

বাবুল সুপ্রিয়

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:৪৯
Share:

বাবুল সুপ্রিয় ও তাঁর মা

২০১৯-এর ডিসেম্বর মাস। বাবা-মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। মার্চের শেষে ওরা আমেরিকায় আমার বোনের কাছে যাবে। তাই আমি বলেছিলাম, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দিল্লিতে আমার কাছে চলে আসতে। দিল্লির প্রচণ্ড ঠান্ডাকে আমার অশীতিপর বাবা বেশ ভয় পায়। কিন্তু এ বার রাজি হয়ে গেল। দিল্লি থেকেই সরাসরি আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আমার কাছে চলে এল।

Advertisement

বাবা-মায়ের উপস্থিতির উষ্ণতায় দিল্লির ঠান্ডাটা ভালবাসা আর ভাললাগার চাদরে ঢাকা পড়ে আরও জমে উঠল। দারুণ কাটল দু’টো মাস। আমার তিন বছরের মেয়েও মা-বাবার কাছ থেকে বাংলা শিখতে আরম্ভ করল। অফিস থেকে ফিরে মায়ের হাতের চা আর মুড়ি-চানাচুর খেতে খেতে মেয়ের গলায় আধো আধো স্বরে মা-বাবার শেখানো ‘হাট্টিমাটিম টিম, তারা মাঠে পাড়ে ডিম’, ‘লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া’ বা ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ শুনতাম। এক কথায় দারুণ লাগত। বাচ্চাদের জীবনে গ্র্যান্ড পেরেন্টসদের একটা অনন্যসুন্দর ভূমিকা থাকে। আজকালকার দুনিয়ায় ‘নানা কারণে’ যা থেকে আজকের বাচ্চারা বঞ্চিত, আমার মেয়ে তার পুরোটাই পাচ্ছে দেখে আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ত।

এরপর এল সেই সময়। করোনা মহামারি। অদ্ভুত একটা সময় গ্রাস করল পৃথিবীকে। আমেরিকা যাওয়ার ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেল। স্বাধীনতা অবরুদ্ধ হল ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে। তারপর ঘটল আরও অনেক কিছু। বেশিরভাগই ভয়ানক। যার কথা মানবসভ্যতার ইতিহাসের পাতায় পড়েছি। কিন্তু তার প্রকৃত ভয়াবহতা কখনও অনুভব করিনি। তারপর অনেক কিছু দেখলাম। হাতেকলমে জানলাম। লকডাউন, আনলক, কোয়ারান্টিন, হোম কোয়ারান্টিন, আইসোলেশন আরও কত কী! কিন্তু এ সবের মধ্যেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম— মা-বাবাকে আর কখনও কাছ-ছাড়া করব না। দিল্লির বাড়িতেই তাদের যাকে বলে, ‘বন্দি’ করে ফেললাম।

Advertisement

আরও পড়ুন: জাতীয় সঙ্গীতের জাত বিচার এবং আজকের রাজনীতি

সারা পৃথিবীতে যখন মৃত্যুমিছিল চলছে, সোশ্যালি-মেডিক্যালি-ইকনমিক্যালি-মেন্টালি সবদিক থেকেই মানবজাতি যখন আরও আরও কোণঠাসা হয়ে পড়তে লাগল, তখন শুধুমাত্র একটি পাওয়াই মনকে শান্ত করত। হাজার চাপের মধ্যেও আনন্দ দিত— মা-বাবার সঙ্গে টানা সাত-আট মাস নির্ভেজাল সময় কাটানোর সুযোগটা। কোনও সাধারণ বাড়িতে যা যা হয়, তার সবটুকুই হতে লাগল আমাদের বাড়িতে। তার মধ্যে মায়ের হাতের আলু-পোস্ত আর বাবার সঙ্গে বেশি রাত্রে চা সহযোগে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানও ছিল। আমার মা আর বউয়ের মধ্যে ‘টিভি সিরিয়াল টাইপ’ ছোটখাটো ঝগড়া আর খুনসুটিও ছিল।

বাড়ির বাইরে কাউকে বেরোতেই দিতাম না। সব গাড়িচালককে মন্ত্রীমশাইয়ের কড়া নির্দেশ ছিল, লুকিয়েও কেউ যেন মা’কে কাছের সরোজিনী মার্কেটে টুকিটাকি কিনতে বা বাবাকে চিত্তরঞ্জন পার্কের চেনা মাছওয়ালার কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করে।

আরও পড়ুন: কৃষি বিল আর অতিমারি নিয়ে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ২৫০ পূর্তি

তখন আনলক পর্ব শুরু হয়েছে। বুঝতে পারতাম, মা-বাবাও স্বাভাবিক ভাবেই বেরনোর জন্য একটু অধৈর্য হয়ে পড়েছে। হাজার বারণ সত্ত্বেও মাস্ক পরা বেশ কমিয়ে দিয়েছে। সে বিচ্যুতিগুলোতে ‘বললেও না শুনলে আমি আর কী করব’, কিংবা ‘আমি আর কিছু বলি না’ জাতীয় ক্লিশে লাইনগুলো বলে কখনও মেনে নিইনি।

কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলাম কই!

নভেম্বরের মাধামাঝি প্রথমে আমার, তারপর মায়ের, শেষে বাবার কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট এল। দু’-তিনদিন হোম কোয়ারান্টিনে চিকিৎসার পরে মা-বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হল। বাবা প্রায় ১০ দিন পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এল। ততদিনে আমি নিজে শারীরিক ভাবে সুস্থ হয়েছি কি না, ভাবার সময়ই পাইনি। শুধু জানতাম, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমার রিপোর্ট নেগেটিভ এসে গিয়েছে। আসলে মানসিক ভাবে আমি পুরোপুরি হাসপাতালে মায়ের বেডের পাশে ছিলাম। সকলকে আশা দিতাম। কিন্তু চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছিলাম, মায়ের শারীরিক অবস্থা দিনের পর দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

তার কয়েক দিন আগেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়েছি। ওঁর মেডিক্যাল বুলেটিনগুলো মন দিয়ে দেখতাম। কোথাও যেন মনে হচ্ছিল, পরিস্থিতিটা মিলে যাচ্ছে। শেষ পরিণতির কথা ভাবলেই মনটা কেঁপে উঠত। হাসপাতাল ছেড়ে বেরোতেই ইচ্ছে করত না। মনে হত, হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে গেলেই ছেলে-অন্ত মায়ের প্রাণটাও আকাশে মিলিয়ে যাবে।

সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়ে গেল ২১ দিনের মাথায়। ৯ ডিসেম্বর যমে-মানুষে টানাটানির লড়াইয়ে হেরে গেলাম। মায়ের হাতটা খুব শক্ত করে ধরেছিলাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কেউ যেন হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। প্রমাণ করে দিয়ে গেল, ‘নাথিং কাম্স ফ্রি ইন লাইফ’। এ জীবনে সবকিছুর জন্যই দাম দিতে হয়। পৃথিবীতে সবকিছুরই মূল্য চোকাতে হয়। যে করোনার জন্য মা-বাবার সঙ্গে টানা ৩০০ দিন উপভোগ করার সুযোগ আর আনন্দ পেলাম (১৯৯২ সালের পর থেকে যা কখনও পাইনি), সেই করোনাই আমার কাছ থেকে আনন্দের চরম মূল্য নিয়ে গেল। আমার মা’কে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল।

সত্যজিৎ রায়ের ছবির সংলাপ ‘দ্য হাইয়ার ইউ রাইজ, দ্য বিগার দ্য ফল’ (যত উপরে উঠবে, পতনটা তত বড় হবে) কোনও দিনই মানতাম না। ওপরে ওঠার সময় সাবধানে থাকলে ‘পতন’-টা কখনও ততটা হতে পারে না বলেই মনে করতাম। এখনও সেটাই মানি। কিন্তু মায়ের চলে যাওয়াটা কোথাও যেন সেই অঙ্কটা খুব নিষ্ঠুর ভাবে মিলিয়ে দিয়ে গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন