লঘু ও গুরু

পঞ্চম তফসিলের ক্ষেত্রে ভারত নামক রাষ্ট্রের নীতি ও কেন্দ্রের শাসক দলের রাজনীতি একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। রাষ্ট্র বলিতেছে, তফসিলি অঞ্চলে জনজাতির সংস্কৃতি সুরক্ষিত রাখিতে গ্রামসভা ভূমিকা লইতে পারে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৯ ০০:০১
Share:

দুই বৎসর পূর্বে ঝাড়খণ্ডের নাট্যকর্মী জিতরাই হাঁসদা ফেসবুকে মন্তব্য করিয়াছিলেন, গোমাংস ভক্ষণ জনজাতি সংস্কৃতির অঙ্গ। সাঁওতালরা যদি ভারতীয় হন, তাহা হইলে কোনও আইন হিন্দু রীতি ও আচার লইতে তাঁহাদের বাধ্য করিতে পারে না। সেই পোস্টের জন্য গত শনিবার গ্রেফতার হইয়াছেন জিতরাই। তাঁহার আইনজীবীর দাবি, জনজাতির ভোট হারাইবার ভয়েই এত কাল নিষ্ক্রিয় ছিল সরকার, ফল অনুকূল হইতেই মাঠে নামিয়াছে প্রশাসন। তবে বৃহত্তর প্রশ্নটি তুলিয়াছেন সাঁওতাল রাজনীতিক সূর্য সিংহ বেসরা। তাঁহার মতে, পঞ্চম তফসিলভুক্ত অঞ্চলে জনজাতি ও মূলবাসীদের অধিকার রক্ষার স্বার্থে গোমাংস নিষিদ্ধ করা চলিতে পারে না। সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি নির্দেশিত অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাৎপদ ও অনুন্নত এই সকল এলাকায় কেন্দ্রীয় সরকারকে নজর রাখিতে হয় যেন মূলবাসী মানুষের জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ অ-মূলবাসীদের দখলে চলিয়া না যায়। অথচ, সেই রাজ্যে ২০০৫ সাল হইতে গোহত্যা নিষিদ্ধ, যাহা সাঁওতাল সংস্কৃতির পরিপন্থী। ইহাই সঙ্কটের মূল।

Advertisement

বস্তুত, পঞ্চম তফসিলের ক্ষেত্রে ভারত নামক রাষ্ট্রের নীতি ও কেন্দ্রের শাসক দলের রাজনীতি একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। রাষ্ট্র বলিতেছে, তফসিলি অঞ্চলে জনজাতির সংস্কৃতি সুরক্ষিত রাখিতে গ্রামসভা ভূমিকা লইতে পারে। কিন্তু দুই বৎসর পূর্বে যখন ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি রক্ষা করিতে জনজাতির মানুষ পত্থলগড়ী আন্দোলন গড়িয়া তুলিলেন ও গ্রামে স্বশাসনের নিমিত্ত পাথর পুঁতিলেন, তখন চটিয়া লাল হইল ঝাড়খণ্ডের বিজেপি। বস্তুত, পাঁচ বৎসর পূর্বে রঘুবর দাসের সরকার রাজ্যের ক্ষমতা দখল করিবার পর হইতে গোমাংস লইয়া কড়াকড়ি বাড়িতে থাকে। গোমাংস ভক্ষণকারী বা বিক্রেতা সন্দেহে গোরক্ষকদের হাতে প্রহৃত হইতে থাকেন একাধিক ব্যক্তি। সুতরাং অনৈতিক হইলেও বাস্তব চিত্র বলিতেছে, রাষ্ট্রের দ্বারা জনজাতি যে অধিকার পাইতেছে, রাষ্ট্রযন্ত্র প্রয়োগ করিয়াই সেই অধিকার কাড়িয়া লইতেছেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা। ভিন্ন রুচির উপর চলমান আক্রমণ হইতে ইহাও বুঝিতে হয় যে দুই প্রক্রিয়া সমান্তরাল ভাবে চলিবার অর্থ রাজনীতির কূটচাল ব্যতীত অপর কিছু নহে।

আশার কথা, জিতরাই বা সূর্যের ন্যায় প্রতিবাদীরা রাজনৈতিক ভাবেই সঙ্কটটিকে প্রশ্ন করিতেছেন। বক্তব্য স্পষ্ট— প্রশাসনিক ভাবে যদি মূলবাসীদের অধিকার সুরক্ষিত করিতে হয়, তাহা হইলে রাজনৈতিক ভাবেও অ-মূলবাসীদের মূল্যবোধ চাপাইবার চেষ্টা চলিবে না। গত এক দশকে ঐতিহ্য ও অধিকার রক্ষার কথা উঠিয়াছে। সেই স্বর জনজাতিকে হিন্দু সমাজে আত্তীকরণের বিরুদ্ধে কথা বলিয়াছে, ‘ঘর ওয়পসি’র নিন্দা করিয়াছে, ভারতের মূল ভূখণ্ডে বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি তালিকায় জনজাতিদের ভাষাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করিবার দাবি জানাইয়াছে, খাদ্যাভ্যাস লইয়া ভীত না হইয়া গর্ব প্রকাশ করিয়াছে। ফল এখনও মেলে নাই। অবশ্য নরেন্দ্র মোদীর আমলে ইহা মিলিবার কথাও নয়। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, সংখ্যালঘু কেবল ধর্মীয় নহে, সাংস্কৃতিকও বটে। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চ হইতে যাহাই বলুন, আচরণ-পোশাক-খাদ্যাভ্যাস না মিলিলে ‘উদার’ ভারতে ঠাঁই হওয়া কঠিন। তবু ভাষ্য বদলাইবার আন্দোলন চলিতেছে, ভবিষ্যতে কোনও দিন ‘মাওবাদী’ ব্যতীত অপর কোনও তকমা জুটিতেও পারে!

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন