বারাক ওবামা
বারাক ওবামার বাগ্মিতা ও বুদ্ধিমত্তার সংবাদ বিশ্বদুনিয়ার অজানা নহে। কিন্তু চলতি সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে নেলসন ম্যান্ডেলার সম্মানে তাঁহার বক্তৃতাটি বিশ্বব্যাপী এত যে বিরাট পরিমাণ আকর্ষণ তৈরি করিল, তাহার প্রধান কারণ বাগ্মিতাও নহে, বুদ্ধিদীপ্তিও নহে। স্বভাবদক্ষতায় কোনও নাম না করিয়া কোনও বিশেষ প্রেক্ষিত ব্যবহার না করিয়া প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে ভাবে একটি বিশেষ রাজনীতি-ধারার তীক্ষ্ণ সমালোচনা করিলেন, তাহাই এমন আকর্ষণ তৈরির কারণ। নাম বা প্রেক্ষিত ব্যবহার না করিয়াই একটি বিশেষ শব্দ তিনি ব্যবহার করিয়াছেন— ‘স্ট্রংম্যান পলিটিকস’ অর্থাৎ বাহুবলী রাজনীতি। তাঁহার মতে, প্রতি পদে অদম্য কঠোরতার ছাপ রাখিতে রাখিতে যাওয়া এই রাজনীতি-ধারাটির সর্ববৃহৎ বিপদ, গণতন্ত্রের বিনাশ। অথচ কী আশ্চর্য, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই এই নেতারা জিতিয়া ক্ষমতায় আসেন, এবং আপাত ভাবে গণতন্ত্র ইঁহাদের কাজকর্মের প্রতিরোধক হইয়াও দাঁড়ায় না। সাধারণ নাগরিক এই বাহুবলীদের তীব্র বিভায় আচ্ছন্ন থাকেন, প্রতিরোধের প্রয়োজনটি ভুলিয়া যান।
বাহুবলী শব্দটি কতটা রূপকার্থে ব্যবহৃত, আর কতটা বাস্তব, তাহা লইয়াও ভাবিবার সুযোগ করিয়া দিয়াছে ওবামার বক্তব্য। যে নেতাদের দিকে তাঁহার ইঙ্গিত, তাঁহারা বাহুবলের উদ্বোধক হিসাবে নাম করিয়াছেন। দেশের সমাজকে মেরুকরণের দিকে টানিয়া লইয়া গিয়া অসহিষ্ণুতা ও আক্রমণপরায়ণতার পরিসর অনেক দূর বাড়াইয়া ফেলিয়াছেন। মার্কিন দেশে এখন নিয়মিত আক্রমণ চলিতে থাকে অভিবাসী ও অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি। ইহার পিছনে নূতন প্রেসিডেন্টের শাসনের অবদান নাই, এমন কথা হয়তো ট্রাম্পও বলিবেন না। তিনি হয়তো বলিবেন, আক্রমণ বাড়িয়াছে কেননা ইহা বাড়িবারই কথা ছিল। এতদুপরি, আরও একটি প্রচ্ছন্ন ‘বাহুবল’ এই নেতাদের সহায়। ক্রমাগত সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করা এবং মিথ্যাকে সত্যের জায়গা দিবার ক্ষমতা ও প্রবণতা তাঁহাদের অমিত ঔদ্ধত্যের মূল— এবং প্রযুক্তির অদ্ভুত প্রকৃতি নানা ভাবে এই অনৈতিক ক্ষমতা ও প্রবণতার বিরাট আশ্রয়। রাজনীতিতে মিথ্যাচার আগেও ছিল। কিন্তু নূতন প্রযুক্তি এবং নূতন প্রবণতা, দুই মিলাইয়া এখন মিথ্যাচার নিয়মিত আচার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মিথ্যাই এখন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী।
ওবামা একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। তাহা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্ব। বাহুবলীরা যে ক্রমেই দুর্দান্ত হইয়া উঠিতেছেন তাহার প্রধান কারণ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষয় এবং, অনেক ক্ষেত্রে, লয়। এই নেতাদের লক্ষ্যই প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করা, সুতরাং তাঁহারা সেই লক্ষ্যেই নিযুক্ত আছেন। যে কোনও মহৎ বক্তব্যের মতোই ওবামার জোহানেসবার্গ ভাষণও শেষ পর্যন্ত একটি আলোকের সন্ধান দেয়। অন্ধকারের মধ্যে পথদর্শনের সেই আলোকরেখাটি বলে, বাহুবলীদের প্রতিরোধ করিতে চাহিলে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকে সর্বশক্তিতে রক্ষা করা দরকার। এক বা একাধিক নেতার আঘাতে যাহাতে এত দিনকার প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা হারাইয়া না যায়, তাহা দেখা দরকার। পরিব্যাপ্ত মিথ্যার মায়ায় ‘বস্তুগত সত্য’-এর আকাশ ঢাকিবার উপক্রম হইলে আত্মরক্ষণের পথই শ্রেয়। শুধু মার্কিন দেশে নহে, অপরাপর দেশেও।