ঢাকা থেকে কলকাতা, পাল্টে যাচ্ছে ভাষার ব্যবহার

বাংলা পথ হারাইয়াছে?

রমজান মাস তখন সবে শুরু হয়েছে, এক মাস পর ইদ-এর প্রতীক্ষা। এই পুরো সময়টায় ঠিক আমাদের পুজো বা দিওয়ালির মতো নানান জিনিসে অফারের ছড়াছড়ি বাংলাদেশে।

Advertisement

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share:

বুঝলাম, অনুযোগের তির ‘অস্থির’ শব্দটার দিকে। ভদ্রলোক স্কুলশিক্ষক, উপরন্তু বাংলা পড়ান। আহত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ফেসবুকে বাংলাদেশি বন্ধুদের, বিশেষত এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সৌজন্যে ‘অস্থির’-এর এমন প্রয়োগ আমার পূর্বপরিচিত। তাঁরা ‘অস্থির’ শব্দটা প্রয়োগ করেন দারুণ, দুর্দান্ত, অনবদ্য-এর মতো বিশেষণের প্রতিশব্দ হিসেবে। ‘সাকিবের ব্যাটিং দেখলি? অস্থির!’ ঠিক যেমন কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে শোনা যায় ‘ব্যাপক’ শব্দের ব্যবহার: ‘রান্নাটা তো ব্যাপক হয়েছে!’ বা, ‘সিনেমা কেমন দেখলে?’ ‘ব্যাপক!’

Advertisement

বছর দুয়েকও পেরোয়নি, খবরকাগজে এক মোবাইল সংযোগ পরিষেবা সংস্থার দেওয়া পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে বাংলার বহর দেখে তুমুল শোরগোল পড়ে দিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। ‘সম্পর্কতা’, ‘প্রমিস বানান’-এর মতো বাংলা (?) শব্দ ছিল সেখানে, বাক্য গঠনের কায়দা দেখে পদে পদে হোঁচট খাচ্ছিল মগজ। বোঝাই যাচ্ছিল, মূল ইংরেজি বিজ্ঞাপনের বয়ানটি বাংলায় অনুবাদ করার দুর্বল, অক্ষম চেষ্টা করেছেন সংস্থার অনুবাদক-কর্মী। হাসি-ঠাট্টার পর্ব পেরিয়ে ফেসবুক-টুইটারে প্রতিবাদ জানান অজস্র বাঙালি। পরে সংশ্লিষ্ট সংস্থাও টুইটারে ক্ষমা প্রার্থনা করে। জানায়, এ অনুবাদকদের ভুল, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের গভীরতম শ্রদ্ধা আছে। বাংলাপ্রেমী মানুষ প্রশ্ন তুলেছিলেন, সংস্থার নিযুক্ত অনুবাদকেরা আদৌ বাঙালি তো? তাঁদের শব্দচয়ন ও বাক্যবিন্যাস দেখে তো তা মনে হচ্ছে না মোটেই; বরং মনে হচ্ছে গুগল ট্রান্সলেটর গোছের প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েই কাজ সারা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই ‘বাংলা বাঁচাও’ রব পড়েছিল চারদিকে, এবং সোশ্যাল মিডিয়ার যা দস্তুর, গালাগালির বন্যা বয়ে গিয়েছিল। তালেগোলে আর এক কাণ্ড হয়েছিল, কিছু মানুষ ওই বিজ্ঞাপনের সূত্রেই ‘মান্যতা’ শব্দটার পিছনে পড়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্য, ‘সম্পর্কতা’র মতোই ‘মান্যতা’ শব্দটাও হতে পারে না, তা সে যতই বলিউডি হিরোর স্ত্রীর নাম হোক না কেন। অথচ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ জ্বলজ্বল করছে ‘মান্যতা’, অর্থ ‘মান্যভাব, পূজ্যত্ব’। মোবাইল পরিষেবা সংস্থা হরিচরণের দ্বারস্থ হয়েছেন, এ না হয় অবিশ্বাস্য। কিন্তু বাঙালির অজ্ঞতা? অবিশ্বাস্য নয়?

কিন্তু পরিস্থিতি ঘোরালো এবং প্রতিবাদ জোরালো হল পরে, যখন বোতলের গায়ে শব্দগুলো পাল্টে গিয়ে এল নতুন শব্দের ঝাঁক—‘কড়া’, ‘অস্থির’, ‘ঢিলা’, ‘মাথানষ্ট’, ‘জটিল’, ‘আগুন’। এ হল এই প্রজন্মের ব্যবহারিক বাংলা, যাকে পপুলার ল্যাংগোয়েজ নামে বেশি চিনি। বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী নতুন প্রজন্ম রোজকার কথাবার্তায় একটা শব্দকে পাল্টে নেয় অন্য অর্থে, যেমন ‘অস্থির’ বা ‘ব্যাপক’-এর অন্যতর প্রয়োগের কথা বললাম। এই শব্দদের দেখে সুশীল সমাজে হইহই উঠল— বাংলাকে বিকৃত করে প্রচার হচ্ছে। ব্যাপার গড়িয়েছে আদালতেও। পুরো ঘটনায় আমার শিক্ষক দাদাটি ব্যথিত, ক্ষুব্ধ। তাঁর বছর চোদ্দোর স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি কিন্তু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, জিন্স ফাস্টফুড মল মাল্টিপ্লেক্স মানতে পারলাম, ভাষার বদল মানতে সমস্যা কী?

Advertisement

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন