Food

মাছে-ভাতে বাঙালি বঞ্চিত দেশি মাছের স্বাদ থেকে

দেশি মাছ হারিয়ে গেলে নষ্ট হয়ে যাবে জলের বাস্তুতন্ত্র। এরা যে সব ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ বা নদীর বর্জ্য খেয়ে নদী ও তার পার্শ্ববর্তী পরিবেশ রক্ষা করে, তা নষ্ট হবে। নদীর জল দূষিত হবে। পরিবেশের স্বার্থে হারিয়ে যেতে বসা মাছেদের সংরক্ষণ জরুরি।তখন নদীতে স্নান করতে নামলেও ছেঁকে ধরত পুঁটি, ট্যাংরা, খোলসে, তেচোখোর ঝাঁক।

Advertisement

সুদীপ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২০ ০০:৪৯
Share:

ফাগুন পূর্ণিমার মায়াবি চাঁদের আলোয় রূপসী জলঙ্গি আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল সে রাতে। নৌকার ছইয়ের মধ্যে টিমটিম করে জ্বলছে লণ্ঠনের আলো। এক ডিঙি নৌকায় হাতে কোঁচ নিয়ে নদীর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে এক কিশোর। কাচের মতো জলের নীচে লম্বাটে একটা ছায়া দেখা যেতেই ছায়া লক্ষ্য করে কোঁচটাকে সজোরে ছুঁড়ে মারে কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে একটা মস্ত বোয়াল মাছের পিঠে গেঁথে যায় কোঁচের তীক্ষ্ণ ফালাগুলো।

Advertisement

জলঙ্গির পাড়ে বসে গল্পটা বলতে বলতে চোয়াল শক্ত হয় জগন্নাথ বিশ্বাসের। দুঃখের সঙ্গে বলেন জগন্নাথ, ‘‘এখন তো এ নদী মরা নদী। একটাও মাছ নেই।’’ বাবার হাত ধরে মাত্র আট বছর বয়সে মাছ ধরার হাতেখড়ি জগন্নাথের। তার পর থেকে বছরভর রাত-দিন ডিঙি নৌকায় চেপে মাছ ধরে জীবনের ৬০খানা ফাল্গুন পার করে ফেলেছেন জগন্নাথ। জগন্নাথেরা তিন ভাই মৎস্যজীবি।

স্মৃতি হাতড়ে জগন্নাথ বলেন, ‘‘বিশ বছর আগেও নদীতে মাছের এত আকাল ছিল না। নদী জুড়ে খেলে বেড়াত ভ্যাদা, জিওল, রাগ, বাটা, কাজরি, গুঁটে, মৌরলা, চাঁদা, আর, ভোলা, বোয়ালের মতো কতশত মাছ। নদীর স্রোতের মুখে দল বেঁধে সাঁতার কাটত বাচা, সিলিন্দে, গরচা, কাজরি, খয়রা, কেঁকলের মতো মাছের দল।’’

Advertisement

তখন নদীতে স্নান করতে নামলেও ছেঁকে ধরত পুঁটি, ট্যাংরা, খোলসে, তেচোখোর ঝাঁক। নদীর পাড়ের কাছাকাছি খানিকটা কচুরিপানা তুললেই‌ তার তলা থেকে পাওয়া যেত ছটকা চিংড়ি, চাঁদা, পুঁটি, ট্যাংরার মতো মাছ। নদীতে স্নান করতে এসে এ ভাবে মাছ সংগ্রহ করে যেতেন অনেকেই। ভূত বেলে নামে কালো রঙের ছোট আকারের এক রকম বেলে পাওয়া যেত জলঙ্গিতে, এখন আর তাদের দেখা মেলে না নদীতে। একটা সময় প্রায় ৭০০, ৮০০ গ্রাম ওজনের এক একটা সাধারণ বেলে মাছও ধরা পড়েছে এই নদীতে। এখন কদাচিৎ ১০০, ২০০ গ্রাম ওজনের একটা, দুটো বেলে ধরা পড়ে বলে জানালেন মৎস্যজীবিরা। নদীতে এখন আর পাবদা পাওয়া যায় না। টাকা চাঁদা বলে গোল আকৃতির সাদা রঙের এক রকম চাঁদা মাছ পাওয়া যেত, যা এখন পাওয়াই যায় না। বর্ষার সময়ে যখন মাছের ডিম পাড়ার সময় হয়, তখন নদীতে নানা ধরনের মাছের দেখা মেলে। একটা সময় বর্ষার চূর্ণী, জলঙ্গি, ইছামতি নদীগুলোয় বা পলদার বিলে ঝাঁকে ঝাঁকে রামেশ্বর ট্যাংরা, পাট ট্যাংরা পাওয়া যেত। এখন ভরা বর্ষাতেও সে সব মাছ পাওয়া দুষ্কর।

জগন্নাথের আক্ষেপ, ‘‘এখনকার ছেলেমেয়েদের অনেকেই তো নদীর সে সব মাছের নামও শোনেনি, চোখেও দেখেনি। তারা তো মাছ বলতে চিনল শুধু রুই, কাতলা আর ইলিশ।’’

তিনি বলেন, ‘‘ব্যাদরা পুঁটি, নোনা পুঁটি, সরপুঁটি, পুঁটিরই কত রকম জাত। আবার বাচা, সিলিন্দে, ঘেরো তিনটে মাছই দেখতে কমবেশি একই রকম।’’ আগে মাছ ধরে ফিরে যাওয়ার সময়ে লোকে খায় না বলে জালে আটকে থাকা যে সব চুনো মাছ নদীর পাড়ে ফেলে দিয়ে যেতেন মৎস্যজীবিরা, আজ বাজারে সেই চুনোমাছই মহার্ঘ। বর্তমান প্রজন্মের মানুষের ভাল করে মাছ না চেনার সুযোগ নিয়ে, আসল বলে নকল মাছও চালিয়ে দিচ্ছেন কোনও কোনও ব্যবসায়ী। যেমন কাঁচকি মাছের বাচ্চাকে সোনা খড়কে বলে বিক্রি করা হয়। দেশি কই বলে দেদার বিক্রি হচ্ছে চাষ করা ভিয়েতনামের কই। দেশীয় প্রজাতির মাছ হারাচ্ছে নদী, পুকুর। মাছে-ভাতে বাঙালিও তাই বঞ্চিত হচ্ছে দেশি মাছের নানা সুস্বাদু পদের স্বাদ থেকে।

এই সব দেশীয় মাছ নদী থেকে হারিয়ে যেতে বসা বা হারিয়ে যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে সিঙ্গুর সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তথা মৎস্যবিদ দেবজ্যোতি চক্রবর্তী বলেন, ‘‘মাছগুলোর হারিয়ে যেতে বসার নানান কারণের মধ্যে খাদ্যাভাব, বাসস্থান হারানো ও পরিবেশ দূষণ হল অন্যতম প্রধান কারণ।’’ তাঁর মতে, ‘‘যেহেতু প্রকৃতির নিয়মে অন্য মাছের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে মাংসাশী মাছেদের সংখ্যা কম, তাই বাস্তুতন্ত্রের নিয়মে প্রথমে হারিয়ে যায় মাংসাশী মাছেরাই। যেমন আড়, বোয়াল, বেলে, ভ্যাদা, জাতীয় মাছ।’’ এরা সাধারণত জলাশয়ের মাঝের স্তরে বাস করে, এদের সংখ্যা কমে এলে জলের বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, যাদের মাংসাশী মাছেরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত তাদের সংখ্যা বেড়ে যায়। ফলে বেড়ে যাওয়া সেই সব কীটপতঙ্গ বিভিন্ন জু-প্লাঙ্কটন, ফাইটো-প্লাঙ্কটন খেয়ে ফেলায় প্ল্যাঙ্কটনভোজী মাছ যেমন রুই, কাতলা, বাটার মতো কার্প জাতীয় মাছেদের খাদ্য ভাণ্ডারে টান পরে। ফলে তারা অস্তিত্বসঙ্কটের মুখে পড়ে।

এরা সাধারণত জলের উপরে ও মাঝের দুই স্তরে বাস করে। জলের উপর ও মাঝের স্তরের মাছেদের বর্জ্যপদার্থ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে জলের একদম নিচের স্তরের মাছেরা। যেমন কাল বাউস, মৃগেল, পাঁকাল। উপরের দুই স্তরের মাছের অস্তিত্বসঙ্কটের ফলে এর পর খাদ্যসঙ্কট হয় জলের নীচের স্তরের মাছেদের। এর পরেও বেঁচে থাকে পুঁটি, খলসের মতো কিছু সুবিধাবাদী প্রজাতির মাছেরা। যারা বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেদের অভ্যাস বদলাতে পারে। কিন্তু পরিবেশ দূষণের কারণে এখন সুবিধাবাদী প্রজাতির মাছেরাও ঘোর সঙ্কটে।

চাঁদা, জিওল, পাবদার মতো বেশ কিছু মাছ বর্ষার সময় নদী দ্বারা প্লাবিত নিচু এলাকায় ডিম পারে। পরবর্তীতে মাছের বাচ্চা সেই জলের ধারা বেয়ে নদীতে চলে আসে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে নদীতে জলের পরিমাণ কমছে। নদীর পারে গড়ে উঠছে বসতি। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসছে। ফলে বর্ষায় আর প্লাবিত হয় না নদী আগের মতো। এ ভাবেই এই ধরনের মাছেদের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তাদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে না।

নানা জাতের চুনো মাছ সহ কই, জিওল, শাল, শোল, ল্যাঠা— এই সব মাছকে এক সময় বলা হত 'আমাছা'। এরা থাকলে চাষ করা মাছের ক্ষতি হবে সেই ধারণায় পুকুরে বিষ দিয়ে এই সব মাছ মেরে ফেলা হত মাছ চাষের সময়ে। ফলে এদের সংখ্যা কমেছে প্রকৃতিতে। নদীতে বেআইনি চট জাল ব্যাপক ব্যবহারে, মাছের ডিম, ধানি পোনা, চারা পোনা থেকে বড় মাছ সবই উঠে আসছে জালে। ফলে মাছের অকাল হচ্ছে নদীতে। এ ছাড়া জলাশয় বা নদীতে সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, তেলাপিয়া, রূপচাঁদার মতো বিভিন্ন বিদেশগত প্রজাতির (Exotic) মাছেদের পরিমাণ বাড়তে থাকায় তাদের সঙ্গে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ক্রমশ হেরে গিয়েও হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছেরা।

নদীর গতিপথে ছোটখাট বাঁধাল থেকে বড় বড় বাঁধ দেওয়ার ফেলেও নদী পথ বেয়ে মাছেদের স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। যেমন অনেক মৎস্যজীবির দাবি অনুযায়ী ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরির পর থেকে নাকি জলঙ্গি নদীতে কমতে শুরু করেছে চাঁদা মাছ।

এই সব দেশীয় মাছ হারিয়ে গেলে নষ্ট হয়ে যাবে জলের বাস্তুতন্ত্র। এরা যে সব ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ বা নদীর বর্জ্য খেয়ে নদী ও তার পার্শ্ববর্তী পরিবেশ রক্ষা করে, তা নষ্ট হবে। নদীর জল দূষিত হবে। দেবজ্যোতিবাবুর মতে, পরিবেশের স্বার্থে অবিলম্বে এই সব হারিয়ে যেতে বসা মাছেদের সংরক্ষণ জরুরি।

যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাছচাষিরা নদী বা পুকুর থেকে ডিম পোনা সংগ্রহ করে বা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পাবদা, সরপুঁটি বা চিতলের মতো মাছের চাষ করছেন, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। বরং নদী বা পুকুর ছেঁকে ডিম পোনা তুলে আনতে গিয়ে যেটুকু মাছ প্রাকৃতিক উপায়ে নদী বা পুকুরে ছিল উল্টে, তার ক্ষতিই করা হচ্ছে বলেই মত তাঁর।

মাছ বাঁচানোর জন্য আমাদের দেশে নেই পর্যাপ্ত আইন। যেটুকুও বা আছে তার উপরে নেই যথার্থ নজরদারি। তাই দেবজ্যোতিবাবুর দাবি, ‘‘ হারিয়ে যেতে বসা দেশীয় মাছগুলো বাঁচাতে সক্রিয় হোক সরকার, কঠিন হোক আইন। জলাভূমি রক্ষায় কঠোর হোক নজরদারি। পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হোক মানুষ। বাসস্থান বাঁচলে তবেই তো বাঁচবে বাসিন্দা। তৈরি হোক মৎস্য অভয়ারণ্য ( fish sanctuary)।’’

তবেই হয়তো আগামীতে আবার কাচের মতো স্বচ্ছ জলে ভরা জলঙ্গির বুকে ঝাঁকে ঝাঁকে খেলে বেড়াবে রুপোর মতো উজ্জ্বল সোনা খড়কে, মৌরলা মাছেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন