বাঙালির লোকবিশ্বাসে ভূতচতুর্দশীর অনেক মাহাত্ম্য

এত প্রকারের ভূত, সারা বছর নিজের নিজের কাজে বিভিন্ন স্থানে ব্যস্ত থাকে। ভূত হলেও রি-ইউনিয়ান করতে ইচ্ছে হয় তো! তাই তারা সকলে মিলে কালীপুজোর আগের দিন দল বেঁধে নেমে আসে। লিখছেন রাহুল হালদারএই দিনে ভূতেদের আগমন হয়, এই কথা কেউ বিশ্বাস করতে পারেন, আবার না-ও পারেন। কিন্তু ভূতচতুর্দশী পালন আমাদের বাঙালির একটা উৎসব, সংস্কার, লোকবিশ্বাস।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৯ ০১:৩৫
Share:

বাঙালির সব চেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো শেষ হল রেড রোডের কার্নিভালের মধ্যে দিয়ে। কলকাতার দুর্গাপুজোকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার জন্য কয়েক বছর ধরে বিদেশি কার্নিভালের অনুকরণে এই চেষ্টা। সেই কার্নিভাল শেষ হয়ে গেল বলে কি বাঙালির উৎসব-আয়োজনের ব্যস্ততা কমে গেল? উত্তরে বলা হবে— না। কারণ, দুর্গাপুজোর বিদেশি অনুকরণে কার্নিভাল রীতি তো নতুন। দুর্গাপুজোর কার্নিভাল অনুষ্ঠানের অনেক আগে থেকেই হুজুগে বাঙালির কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিন পালন করে বিদেশি আরেক রীতির অনুকরণে ভূতচতুর্দশী। এই দিন নাকি অশরীরী আত্মা, যাদের আমরা দেখতে পাই না কিন্তু অনুভব করি, তারা নাকি আমাদের খুব কাছে নেমে এসে আমাদের সঙ্গে মিশে যায়। এই রীতি কিন্তু পাশ্চাত্য দেশেও পালন করা হয়। পাশ্চাত্যের এই রীতিকে বলে— Halloween রীতি। সেই রীতির মতো আমরাও মনে করি কালীপুজোর আগের দিন রাত হল ভূতেদের রাত, ভূতচতুর্দশীর ভয়ঙ্কর তমসাবৃত রাত্রিকাল।

Advertisement

এই দিনে ভূতেদের আগমন হয়, এই কথা কেউ বিশ্বাস করতে পারেন, আবার না-ও পারেন। কিন্তু ভূতচতুর্দশী পালন আমাদের বাঙালির একটা উৎসব, সংস্কার, লোকবিশ্বাস। সুসংহত সমষ্টি যে সমস্ত বিশেষ বিশেষ আচার-আচরণ ক্রিয়াকর্মাদি কর্তব্য-অকর্তব্যের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা সমাজের সকলের ক্ষেত্রে শুভাশুভ মঙ্গলজনিতবোধ জড়িত থাকে, তাকেই আমরা লোকবিশ্বাস বলি। ইংরেজির ‘Folk Belief’-ই হল আমাদের দেশের লোকবিশ্বাস। যা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে পালন করা হয়ে থাকে। এই রকমই একটা লোকবিশ্বাস হল ভূতচতুর্দশী তিথি। সে দিন যত প্রকারের ভূত রয়েছে, তাদের আগমন হয় আমাদের আঙিনায়।

বাঙালি জাতির লোকসংস্কৃতি ও লোকবিশ্বাসে ভূত অনেকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। বাঙালির গল্পে, সিনেমায়, রূপকথা, লোককথায় ভূতের প্রবেশ দীর্ঘদিনের। গা ছমছম করা ভূত-পেত্নির গল্পের আকর্ষণে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই আকর্ষিত হয়। মনে করা হয়, মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মা মুক্তি না পেলে সেই আত্মা অশরীরী রূপে ঘুরে বেড়ায়। বিশেষ করে, কোনও ব্যক্তির যদি স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু না হয়, সেই ব্যক্তি ভূত হয়ে সর্বত্র বিচরণ করে বেড়ায়। বাঙালির গল্পকথায় নানা নামে নানা প্রকারের ভূতের অবয়ব তৈরি করা হয়েছে। পেত্নি হল এই রকমই একটি ভূত সম্প্রদায়ের মহিলা প্রতিনিধি। মনে করা হয়, অবিবাহিতা যে সমস্ত নারী মনের কোনও কিছু অতৃপ্তি নিয়ে মারা যায়, তারা হয় পেত্নি। শাঁকচুন্নিও ভূতগোষ্ঠীর মহিলা প্রতিনিধি। লাল পাড় সাদা শাড়ি ও হাতে শাখা পরিহিতা মৃত নারীই হল শাঁকচুন্নি। যদি কোনও চোর চুরি করার সময়ে অপঘাতে মৃত্যু হয়, তখন সে হয় চোরাচুন্নি ভূত। এই চোরাচুন্নি ভীষণই ভয়ঙ্কর ভূত। এরা কোনও বাড়িতে প্রবেশ করলে বাড়ি তছনছ করে দেয়। শেষে সারা বাড়ি শুদ্ধ করার জন্য গঙ্গাজল দিয়ে ধৌত করতে হয়। বাঙালি মাত্রেই মাছপ্রেমী আর মাছপ্রেমী বাঙালি সমাজে মাছপ্রিয় ভূতের আগমন ঘটবে না, সেটা হয় না কি? নির্জন বাঁশ ঝাড়ে কিংবা পুকুর জলাশয়ের কাছে এক প্রকার ভূতের আস্তানা আছে। এই ভূতগুলির প্রিয় খাবার মাছ, তাই তাদের মেছো ভূত বলে। রাতে যদি কেউ মাছ নিয়ে যায় আর মেছো ভূতের খপ্পরে পড়ে তা হলে তার আর রক্ষা নেই। নিশির ডাক যে শুনেছে তার যে কী হাল হয়েছে, আমরা সেটা ভানুর অভিনয়ে পরতে পরতে জেনেছি। আর এটাও জেনেছি নিশি হল এমন ভূত যে, অতি প্রিয়জনের গলার স্বর নকল করে ডাকতে পারে। তাই রাতবিরেতে এই ডাক শুনলে কিন্তু একা সাহস দেখনোর দরকার নেই। কোথায় কী দুর্ঘটনা ঘটে যায়!

Advertisement

আবার, মামদো ভূত থেকে কিন্তু সাবধান! এই ধরনের ভূত ভীষণ গম্ভীর ও বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন হয়। অমাবস্যার মতো ঘন কালো রাতে আবার আলেয়ার দেখা মেলে। কোনও ফাঁকা প্রান্তরে বা জলাশয়ে আগুন জ্বলার মতো আলেয়ার দেখা মেলে। কিছু ভূত আবার উঁচু-উঁচু তেঁতুল, আঁশশেওড়া, তাল গাছের মাথায় অবস্থান করে। এরা হল গেছোভূত। তবে ভূতের মধ্যে যদি কারও আভিজাত্য থাকে, তবে সে হল ব্রহ্মদৈত্য। এদের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, কোনও ব্রাক্ষণ মারা গিয়ে ভূত হলে সেই ভূত ব্রহ্মদৈত্য হয়। এদের পরনে থাকে ধুতি এবং গলায় থাকে পৈতে। তা ছাড়াও, বাংলায় বেঘোভূত, মাথাকাটা, কানাভুলো, কাঁদরা মা, ঝেঁয়ো পেত্নিরও দেখা মেলে। তা হলে এত প্রকারের ভূত, তারা সারা বছর নিজের নিজের কাজে বিভিন্ন স্থানে ব্যস্ত থাকে। এরা ভূত হলেও তো এদের রি-ইউনিয়ানের ইচ্ছে হয়। তাই তারা সকলে মিলে কালীপুজোর আগের দিন দল বেঁধে নেমে আসে, মিশে যায় আমাদের মধ্যে। এমনটাই বিশ্বাস। আমরা হয়তো দেখতে পাই না, কিন্তু তাদের অনুভব করেন কেউ কেউ।

তাই ভূতচতুর্দশীর দিন গৃহস্থের অমঙ্গল যাতে না হয় এবং গৃহে অপদেবতা যাতে প্রবেশ করতে না পারে, সেই জন্য বাড়ির চোদ্দো কোনায় চোদ্দোটি প্রদীপের আলো জ্বালানো হয়।

আবার, এটাও বলা হয় যে, আমাদের পূর্বপুরুষেরা ওই দিন অন্য লোক থেকে ইহলোকে নেমে আসেন। তাঁরা দেখতে আসেন, তাঁদের ছেড়ে যাওয়া বংশের লোকেরা ঠিকমতো বেঁচেবর্তে আছে কিনা। সেই জন্য এই দিনে অনেক বাড়িতে নেমে আসা পূর্বপুরুষের জন্য জল, মিষ্টির আয়োজন করা হয়। আর তাঁরা সেটা গ্রহণ করে অন্যলোকে যাওয়ার সময়ে পথদিশা দেখানোর জন্য বংশের লোকেরা প্রদীপের আলো দেন। মর্তে রেখে যাওয়া সন্তানদের সুখে থাকতে দেখার পর তাঁদের দেওয়া প্রদীপের আলো দেখে তাঁরা আবার অন্যলোকে ফিরে যান, এমনটাই বিশ্বাস।

প্রদীপ জ্বালানো সম্পর্কে অন্য যে সমস্ত মতের প্রচলন আছে তার মধ্যে একটিতে বলা হয়— এই দিনে রামচন্দ্র চোদ্দো বছরের বনবাস কাটিয়ে অযোধ্যায় ফিরে এসেছিলেন। এত বছরের দুঃখের দিনের অবসানের আনন্দে এবং রামচন্দ্রকে স্বাগত জানানোর জন্য সমগ্র অযোধ্যবাসী প্রদীপ জ্বালিয়ে অযোধ্যা নগরীকে আলোকিত করে দিয়েছিল। সেই থেকে এই প্রথা চলে আসছে।

আর আমরা মনে করি, কারও জীবনে যাতে চোদ্দো বছরের অন্ধকার দিন না আসে, সেই কামনায় চোদ্দো প্রদীপ জ্বালানো হয়। কার্তিক মাসের চতুর্দশীতেই আবার জৈনদের ধর্মগুরু মহাবীর মোক্ষ লাভ করেছিলেন এবং শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ-সহ বাহান্ন জন রাজা এ দিন মুঘলদের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেছিলেন বলে সেই দিনটিকে স্মরণে রেখে জৈন ও শিখ এই দুই ধর্মের মানুষেরাও অন্ধকার আর অজ্ঞানতাকে দূরে সরিয়ে রেখে জ্ঞানের, সত্যের পথে জয়ের হেতু তাঁরাও আলোর উৎসবে শামিল হন।

বাঙালিদের মধ্যে ভূতচতুর্দশীর দিন সন্ধ্যার সময়ে চোদ্দো প্রদীপ দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। শুধু সেটাই নয়, দুপুরের খাদ্য তালিকাতেও থাকে বিশেষ এক পদ, চোদ্দো শাক। চোদ্দো শাকে থাকে ওল, কেও, বেতো, কালকাসুন্দি, নিম, সরষে, শালিঞ্চা, জয়ন্তি, গুলঞ্চ, পলতা, ঘেটু, হিঞ্চে, শুষুনী। অনুমান করা হয়ে থাকে, আগেকার দিনে যখন চিকিৎসা ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না, তখন শীতের মরসুম আসার আগে হেমন্তে ঋতুতে এই সময় শীতের পরশ নিয়ে আসত। হেমন্তে কালে হালকা শীতের আগমনে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাতে গড়ে ওঠে, তাই এই সময়ে মরসুমি চোদ্দো রকম শাকের রান্না খাওয়া হত।

বর্তমান কালে চোদ্দো রকমের উপরে উল্লিখিত শাকের দেখা না পাওয়া গেলেও কালীপুজোর আগের দিন পুরনো রীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য অন্য শাকের সংমিশ্রণে চোদ্দো শাক খাওয়া হয়।

সুতরাং, কার্তিকী অমাবস্যায় চোদ্দো শাক, চোদ্দো পুরুষের প্রতি জল নিবেদন, ভূত, মাটির প্রদীপ, টুনি, এলইডি ল্যাম্পের আলো, আতসবাজি, ডাকাতে কালীমাতার পুজো, ঠাকুর দর্শন— এই সমস্ত কিছু নিয়েই জমজমাট হয়ে ওঠে।

শিক্ষক শান্তিপুর হরিপুর উচ্চ বিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন