যোগফল? নরেন্দ্র মোদী ও জিতনরাম মাঁঝি। মুজফ্ফরপুর, ২৫ জুলাই। ছবি: পিটিআই।
এক বছরের একটু বেশি। ষোড়শ জাতীয় নির্বাচনে বিহারের লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর ২০১৪ সালের জুলাইয়ে নীতীশ কুমার ও লালুপ্রসাদ যাদব হাত মিলিয়ে আঁতাত গড়লেন। দেখেশুনে মনে হল, ২০১৫-র বিধানসভা নির্বাচনে এঁরা তুফান ছুটিয়ে জিতবেন। ২০১৪-এর অগস্টে হল উপ-নির্বাচন। তাতেও ধারণা দৃঢ়তর হল। নীতীশের জেডি(ইউ), লালুর আরজেডি এবং কংগ্রেস দশটি আসনের মধ্যে ছয়টিতে জেতায় তাঁদের সমর্থকদের মধ্যে আশার বান বইল। হ্যাঁ, দশের মধ্যে ছয় হয়তো বিরাট কিছু নয়। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর প্রবল পরাক্রম আর জনপ্রিয়তার ফাঁক দিয়ে অতগুলি আসন জিতে নেওয়াটাকেও তো মুখের কথা বলা যাবে না! অন্তত এইটুকু আশা তো হল যে নীতীশ কুমার আর লালুপ্রসাদের পিছনে যে আলাদা আলাদা জাত-গোষ্ঠীর সমর্থন, তাদের মধ্যে বিশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংঘাত থাকতে পারে, তবু তাদের পক্ষে এখনও একসঙ্গে একটি দলের চিহ্নে ভোট দেওয়া সম্ভব।
তার পর বছর ঘুরেছে। অনেক জল বয়ে গিয়েছে। জেডি(ইউ) আর আরজেডি, দুই দলের সমর্থকদের মধ্যেই বেশ কিছু বিদ্রোহ দেখা গিয়েছে। দুটি দলেরই সমর্থন-ভিত্তিতে আঁচড় পড়েছে। নীতীশের প্রাক্তন ‘সেনাপতি’ দলিত নেতা জিতনরাম মাঁঝি মুখ্যমন্ত্রীর পদটি হারিয়েছেন, এবং সেই ক্ষোভে নতুন দল গড়েছেন গত ফেব্রুয়ারিতে। তাঁর হিন্দু্স্থান আওয়াম মোর্চা এ বার বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভোট-যুদ্ধে লড়তে চলেছে। একই ভাবে, প্রাক্তন আরজেডি নেতা পাপ্পু যাদবও ভোটপ্রবাহে ভাসিয়ে দিয়েছেন নতুন দলের নতুন নৌকো, উঠে-পড়ে লেগেছেন তাঁর পুরনো নেতা লালুপ্রসাদের নাক ঘষে দিতে।
এই পরিস্থিতিতে বিজেপি যে কতখানি উৎফুল্ল, সে আর বলে দিতে হয় না। জেডি(ইউ) এবং আরজেডি-র এক-একটি করে সংকট এসেছে, আর নীতীশ আর লালুর জনতা পরিবারের মধ্যে মাথা গলিয়ে নতুন জমি দখল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে জিতনরামকে সরতে হল যখন, বিজেপি তাড়াতাড়ি ঘোষণা করে দিল, এ হচ্ছে সমগ্র দলিত জাতির অবমাননা! বলল, জেডি(ইউ) হল দলিত-বিরোধী দল। জিতনরাম যে তাঁর দলিত সমর্থন নিয়ে বিজেপিতে ঢুকে এসেছেন, এতে বিজেপির লাভ অনিবার্য।
তবে, লাভ ঠিক কতখানি, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। দেখেশুনে মনে হয়, লাভের পরিমাণ সীমিত। মহাদলিতরা প্রশাসনিক দিক দিয়ে দেখলে বিরাট একটা দল, বিহারের মোট জনসংখ্যার প্রায় দশ শতাংশ। কিন্তু, অন্যান্য পশ্চাদপর জাতি (ওবিসি) এবং অতি পশ্চাদপর জাতি (ইবিসি)-র মতোই মহাদলিতরাও ভেতরে বহুধাবিভক্ত। চামার, মুশহার, পাসি, ডোম, এরা সকলেই এর মধ্যে আলাদা আলাদা জাত-গোষ্ঠী। মহাদলিত নামক প্রশাসনিক গোষ্ঠীটি সরকারি প্রশাসনের চোখে যতই সুসংবদ্ধ হোক না কেন, আসলে কিন্তু ভোটের সময় এই ভেতরের সামাজিক জাত-গোষ্ঠীর আলাদা পরিচয়গুলিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। জিতনরামের সমর্থন প্রধানত মুশহারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর মাঠেঘাটে ঘুরে যেটুকু বুঝতে পেরেছি— এই মুশহার ভোটটা সম্ভবত পুরোটা তিনি পাবেন না। ভোটটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে তাঁর এবং নীতীশের মধ্যে।
অন্য দিকে, মাফিয়া ডন রাজেশ রঞ্জন, যাকে গোটা দেশ পাপ্পু যাদব নামেই বেশি ভাল করে চেনে, তাঁর জনপ্রিয়তা বিহারের সীমাঞ্চল এলাকার মধ্যেই, আরও স্পষ্ট করে বললে, ওই এলাকার যাদবদের মধ্যেই। পাপ্পু যাদব বিষয়ে একটা কথা মনে রাখতে হবে। রাজনৈতিক জীবনে ইনি বার বার দল পাল্টেছেন। সম্প্রতি দিল্লি গিয়ে মোদীর সঙ্গেও মিটিং করে এসেছেন। এঁর দল জন অধিকার মোর্চা যে বিজেপি-র সঙ্গে হাত মেলাবে, ধরেই নেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কিন্তু বিজেপি-অক্ষ যদি জনতা পরিবারের ভোট ভাঙাতে হিসেব করে প্রার্থী দেয়, সুফল পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা।
একটা কথা বলতেই হবে। জনতা মোর্চার কপালে কয়েকটা অপ্রত্যাশিত আঘাত জুটেছে ঠিকই, তবে এঁরা ইতিমধ্যেই কয়েকটা অভ্যন্তরীণ সংকট দারুণ ভাবে সামলেও উঠেছেন! সংকটগুলি সামাল দিতে না পারলে কিন্তু ভোটের ময়দানে এর মধ্যেই এঁদের বিপদ ঘনাতে পারত। যেমন, বহু আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত করে মোর্চার পক্ষ থেকে নীতীশ কুমারকেই নিশ্চিত মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা নিঃসন্দেহে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ‘উন্নয়ন পুরুষ’ হিসেবে নীতীশের খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা, দুটোই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। বিজেপি যে আরজেডি-র পুরনো ‘জঙ্গল রাজ’-এর স্মৃতি উশকানোর নিরন্তর চেষ্টায় ব্যস্ত, নীতীশকে মুখ্যমন্ত্রী করার সিদ্ধান্তের ফলে সেই স্ট্র্যাটেজিটিকেও অকেজো করা গিয়েছে। নীতীশ-লালু এই সে দিন যুগ্মভাবে আসন ভাগাভাগির সিদ্ধান্তটিও ঘোষণা করেছেন। দুই দলের ভাগেই একশোটি করে আসন, আর কংগ্রেসের চল্লিশটি। নীতীশ কুমার যে আরজেডি ও তার প্রধানের মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করে চলেছেন, অন্য কিছু ঘটনা থেকে সেটাও বোঝা যায়। সম্প্রতি অনন্ত সিংহ ও সুনীল পান্ডে নামে জেডি(ইউ)-এর দুই ভূমিহার বিধায়ককে বিহার পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাঁদের দুই জনের বিরুদ্ধেই একাধিক ফৌজদারি মামলা ছিল। নীতীশ কুমারের উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধে হয় না। যাদব ভোটারদের তিনি খুশি রাখার চেষ্টা করছেন। নিজের দিকে টানছেন।
বিজেপি এ দিকে জিতনরাম মাঁঝির হিন্দুস্থান আওয়াম মোর্চার সঙ্গে জোট বাঁধার পাশাপাশি কৌশলগত জোট করছে রামবিলাস পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি আর উপেন্দ্র কুশওয়াহার নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রীয় লোক সমতা পার্টির সঙ্গেও। স্বভাবতই, রাজ্যের প্রধান জাত-গোষ্ঠীগুলির মধ্যে থেকে ভোট টানার চেষ্টায় বিজেপি এ বার অনেকটাই সফল হবে বলে মনে হয়। বিভিন্ন জায়গায় আপাতত গেরুয়া পার্টি জাত-মহাসভা করতে ব্যস্ত। তাতেও সমর্থন বাড়ছে। এত দিন বিহারে বিজেপির ভোট সীমিত ছিল চারটি উচ্চবর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে, অর্থাৎ রাজ্যের জনসংখ্যার ১৩ শতাংশের মধ্যে। এই অংশের মধ্যে সমাজবাদী দলগুলির প্রভাব বিজেপির কাছে একটা সমস্যা হতেও পারত। তবে সেই প্রভাব আটকানোর জন্য বিজেপির নিজস্ব বিশ্বস্ত সমর্থক-শিবিরই যথেষ্ট বলে মনে হয়।
জেডি(ইউ) এবং আরজেডি-র বিশ্বস্ত সমর্থকরা অবশ্য গোটা রাজ্যেই ছড়িয়ে। আসন ভাগাভাগির পর দুই দলেরই কিছু ভাল প্রার্থীর কপাল পুড়বে। যেমন আসন তাঁরা দলের থেকে আশা করেছিলেন, ততটা জুটবে না। এবং তখন তাঁরা বিক্ষুব্ধ হয়ে দল থেকে পেরিয়ে যাবেন। হয় নির্দল প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়াবেন, নয়তো কে বলতে পারে, বিজেপিই তাঁদের টিকিট দেবে!
অন্য দিকে বিজেপি কিন্তু নিজের প্রার্থী নির্বাচন করার ব্যাপারে অনেকটা সুবিধেজনক অবস্থানে থাকবে। যে সব যাদব-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে আরজেডি লড়বে, বিজেপির সেখানে অ-যাদব প্রার্থী দিতেও অসুবিধে নেই। কিন্তু যে সব যাদব-অধ্যুষিত কেন্দ্রে জেডি(ইউ) দাঁড়াতে চলেছে, সেখানে বিজেপি-র পক্ষে যাদব প্রার্থী দেওয়াই বুদ্ধির কাজ হবে। এই ভাবে খেললে শেষ পর্যন্ত বিজেপি-রই লাভ হওয়ার সম্ভাবনা। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে জেডি(ইউ)-আরজেডি-র এত কালের সমর্থকদের অন্তত কিছু অংশ এ বার তাদের ভোট না দিয়ে বিজেপি-র দিকে সরে যাবে।
জেডি(ইউ) এবং আরজেডি, দুই দলই পঁচিশ বছর এই রাজ্য শাসন করেছে। আগেকার শাসনের অভিজ্ঞতা থেকেই অনেকে তাঁদের বিপক্ষে ভোট দেবেন, এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। সে ক্ষেত্রেও বিজেপি-র লাভ। নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা কমছে বলে গোটা দেশের প্রচারমাধ্যম বলছে। কিন্তু বিহারে তাঁর জনসভার বিশাল ভিড় সে কথা বলছে না! বিহারের ছবি থেকে মনে হচ্ছে, তিনি এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। বিজেপির তরফে যেহেতু এখনও কোনও মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থীর মুখ পাওয়া যাচ্ছে না, প্রধানমন্ত্রীর মুখটিকেই তাই তারা প্রাণপণ আঁকড়ে ধরছে। এখন পর্যন্ত তাতে ফলও মিলছে।
তবু ‘টিম নীতীশ কুমার’-এর এখনও আশা আছে। গত দশকে নীতীশ কুমার একটা বিরাট সাফল্য পেয়েছেন। মহিলাদের মধ্যে, সব রকম জাত-গোষ্ঠীর মধ্যে নতুন সমর্থন-ভিত্তি লাভ করেছেন। তাঁর কতকগুলি সংস্কার এই ব্যাপারে সাহায্য করেছে। যেমন, পঞ্চায়েতি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন নাগরিক কমিটি, কিংবা শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ, এবং সব জাতের সব গোষ্ঠীর মহিলাদের জন্য কতকগুলি উন্নয়ন পরিকল্পনা। সেই দিক দিয়ে, এ বারের ভোটে নীতীশ কুমারের জনপ্রিয়তার পরীক্ষা কেবল জাতের ভিত্তিতে হবে না। জাত-নিরপেক্ষ ভাবে সামগ্রিক সমাজের প্রেক্ষিতে তাঁর পরীক্ষা।
সুতরাং, বিহার এ বার জনতা জোট আর বিজেপি জোটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখবে। এই বছরের গোড়ায় দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে লজ্জাকর পরাজয়ের দাগ বিজেপির গা থেকে এখনও মিলায়নি। বিহারেও যদি আবার হারতে হয়, কেন্দ্রীয় সরকার মুশকিলে পড়বে। এত রকম বিতর্কিত বিল এখন লোকসভায়়, এর মধ্যে সরকারের জনভিত্তির আশ্বাস না পেলে সেগুলি পাশ করানোই কঠিন। উল্টো দিকে, জনতা জোট যদি হারে? সমাজবাদী পার্টিগুলির পতন ত্বরান্বিত হবে, সন্দেহ নেই। পরের বিধানসভা নির্বাচনটিই উত্তরপ্রদেশে (২০১৭)। সেখানেও এই গোত্রের দলগুলির উপর বড় রকমের প্রভাব পড়বে। আর একটা কথা। এ বার হেরে গেলে, ব্যক্তিগত ভাবে, নীতীশ কুমার আর লালুপ্রসাদ যাদব, কেউই আর রাজনীতির মঞ্চে মাথা উঁচু করে ফিরতে পারবেন বলে মনে হয় না।