বিস্ময়ের ঘোর কাটিতে আরও সময় লাগিবে। যে ভঙ্গিতে হীরক ব্যবসায়ী নীরব মোদী পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক হইতে সাড়ে এগারো হাজার কোটি টাকা তছরুপ করিয়াছেন বলিয়া অভিযোগ, তাহা এত দিন বলিউডের চিত্রনাট্যেই দেখা যাইত। কেহ বলিতে পারেন, যে-কোনও ছবির চিত্রনাট্য নহে— একই সঙ্গে অবাস্তব হাসি ও হাড় হিম করা ভয়ের ছবি। তছরুপের চরিত্র যতখানি সামনে আসিয়াছে, তাহাতে স্পষ্ট, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের তরফে গাফিলতি যেমন পাহাড়প্রমাণ, রিজার্ভ ব্যাংকের ঔদাসীন্যও বোধ করি তুচ্ছ করিবার নহে। অভিযোগ, পিএনবি-র নামে ভুয়া লেটার অব আন্ডারটেকিং তৈয়ারি করাইয়া বিদেশে বিভিন্ন ভারতীয় ব্যাংকের শাখা হইতে টাকা তুলিয়া লইয়াছে সংস্থাটি— অর্থাৎ, সংস্থার হইয়া পিএনবি বিদেশি মুদ্রায় ধার করিয়া গিয়াছে— কিন্তু সেই ব্যাংকের খাতায় এই ধারের উল্লেখমাত্র নাই। সাত বৎসরে নাকি তাহা ধরা পড়ে নাই! তাহার মধ্যে ব্যাংকের হিসাবপরীক্ষা (অডিট) হইয়াছে, সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারনেট ফিনানশিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) অডিট হইয়াছে— কিন্তু তছরুপটি কাহারও চোখে পড়ে নাই। অভিযোগ, রিজার্ভ ব্যাংকও ব্যাংকের জমাখরচের হিসাবের দিকে যথেষ্ট ঠাহর করিয়া দেখে নাই। কেলেঙ্কারিটি প্রকাশ্যে আসায় এখন ‘শাখাস্তরের কোনও অধস্তন ম্যানেজার’-এর ঘাড়ে দোষ চাপাইবার প্রয়াস চলিতেছে। যদি কোনও ব্যাংকে ক্ষুদ্র মাপের কোনও আধিকারিক বন্ধক ব্যতিরেকে সাড়ে এগারো হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, এবং উচ্চতর কোনও কর্তা সেই হিসাবটি দেখিবার প্রয়োজন বোধ করেন না, তবে বিশ্ব ব্যাংকিং-এর দরবারে তাহার জন্য নিশ্চয় সোনার সিংহাসন রাখা থাকিবে। অথবা, এই ‘গল্পের’ রচয়িতার দুনিয়ার সেরা আজগুবি গল্পকারের খেতাব মিলিবে।
নীরব মোদীরা কেন এই বিপুল পরিমাণ ঋণ পাইয়া থাকেন, কেন তাঁহাদের অনাদায়ী ঋণের অঙ্কটি আকাশ ছুঁইলেও তাহা কর্তাদের নজরে পড়িতে চাহে না, তাঁহাদের আর্থিক গোলযোগের সংবাদ প্রকাশ্যে আসিবার পূর্বেই তাঁহারা কী করিয়া পগার পার হইয়া যান— এই প্রশ্নগুলির উত্তরে অনিবার্য ভাবেই রাজনীতির ছায়া পড়িবে। যাঁহারা প্রশ্নাতীত রকম প্রভাবশালী, তাঁহাদের হইয়া ব্যাংককে চাপ দেওয়ার লোকেরও অভাব হয় না। নীরবের প্রভাবের একটি দৃশ্যমান কারণ, রাজনৈতিক নেতৃত্বের শীর্ষস্তরের নৈকট্য। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সহিত বৈঠক করিতে পারেন, এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সেই কথা টুইট করিয়া জানান। সরকারি ছবির এক ফ্রেমে দুই মোদীর সহাবস্থান। প্রশ্ন উঠিবেই, যিনি প্রধানমন্ত্রীর এতখানি নিকটবর্তী, তাঁহার অগ্রপশ্চাৎ যাচাই করিয়া দেখা কি সরকারি গোয়েন্দাদের কর্তব্য নহে? না কি, নৈকট্যের প্রভাব এমনই গভীর ও ব্যাপক যে কোনও সংস্থার ততখানি সাহস হয় নাই? অথবা, কোনও স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ছিল?
তথ্য মিলিতেছে, গত চার বৎসরে পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের মূলধনী খাতে সরকারের অর্থবরাদ্দের পরিমাণ দশ গুণ বাড়িয়া বর্তমান অর্থবর্ষে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকায় ঠেকিয়াছে। অনাদায়ী ঋণের দায়ে ধুঁকিতে থাকা ব্যাংকের পুনরুজ্জীবনের অভিমুখে মূলধনী খাতে অর্থসংস্থানকে সরকার সংস্কার হিসাবে দেখাইতেছিল। কিন্তু, সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকে করদাতার টাকা ঢালিয়া দিবে, আর ব্যাংক বিনা প্রশ্নে নীরব মোদীদের সেই টাকা জোগাইবে— অর্থাৎ, ঘুরপথে সরকারই রাজকোষের টাকায় নীরব মোদীদের ভরতুকি দিয়া চলিবে? নীরব কেলেঙ্কারির মাপ পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের মোট আর্থিক আয়তনের সিকি ভাগ। ব্যাংকে মূলধন ঢালিবার নীতি লইয়া স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিবে। উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠিলে প্রধানমন্ত্রী সচরাচর নীরব থাকেন। সেই নীরবতা কি এ ক্ষেত্রেও ভাঙিবে না?