মমতার বহুমুখী কৌশলে পাহাড়ে কোণঠাসা গুরুঙ্গ

এক দিকে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাহাড়ের অন্য রকম ডায়েরি লিখলেন জয়ন্ত ঘোষালবেশ কয়েক বছর পর দার্জিলিং গেলাম। চারপাশ অনেক বদলে গিয়েছে। যাঁরা অতীতের দার্জিলিং দেখেছেন তাঁরা সকলেই এ কথা স্বীকার করবেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এর আগে এক বার সিকিম এসেছিলেন, সে বার বাগডোগরা বিমানবন্দর ছুঁয়ে দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৬ ০০:২৫
Share:

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

বেশ কয়েক বছর পর দার্জিলিং গেলাম। চারপাশ অনেক বদলে গিয়েছে। যাঁরা অতীতের দার্জিলিং দেখেছেন তাঁরা সকলেই এ কথা স্বীকার করবেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এর আগে এক বার সিকিম এসেছিলেন, সে বার বাগডোগরা বিমানবন্দর ছুঁয়ে দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ বার মমতার অনুরোধে টানা তিন দিন দার্জিলিংয়ের রাজভবনেই কাটালেন। আপাত নিরীহ এই ঘটনার মধ্যে যে কত গভীর রাজনীতির বার্তা রয়েছে সেটা প্রণব আর মমতার সঙ্গে এক সঙ্গে তিন দিন কাটিয়ে প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারলাম। প্রণববাবু হলেন ভারতের প্রথম নাগরিক। ভারতীয় সংবিধানের প্রধান আনুষ্ঠানিক রক্ষাকর্তা। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। দার্জিলিং যে বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ! এক কথায় বলা যায়, এ হল গোর্খা-নেপালির কুকরি থেকে সংবিধানের যাত্রাপথের কাহিনি।

Advertisement

এর আগে কখনও মমতার সঙ্গে দার্জিলিং যাইনি। কলকাতার কিছু সাংবাদিক বেশ কয়েক বার তাঁর সঙ্গে গিয়েছেন। তাঁদের কাছে ব্যাপারটা নতুন নয়। কিন্তু মমতা এবং দার্জিলিং ছিল আমার সাংবাদিক জীবনের অনাবিষ্কৃত অধ্যায়। যে ভাবে মমতা কালীঘাট-হাজরা-ভবানীপুরের রাস্তা চেনেন, যে ভাবে মেদিনীপুর বা বর্ধমানের গ্রামগুলি চেনেন ঠিক সে ভাবেই দেখলাম তিনি জানেন দার্জিলিংয়ের রাস্তাঘাট। এমনকী, কালিম্পং-কার্শিয়াংয়ের রাস্তাঘাটও তাঁর অচেনা নয়। দার্জিলিংয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নিবাস অথবা মুখ্যমন্ত্রীর অতিথিশালা থেকে টাইগার হিল, ম্যাল থেকে রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত নিবেদিতার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের নিবাসটি পর্যন্ত তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। বৃষ্টি পড়ছে। তবু তারই মধ্যে একটি প্লাস্টিকের ওয়াটারপ্রুফ, হাতে ছাতা ও পায়ে সেই সাদা চপ্পলটি পরে তিনি বাঁই বাঁই করে হেঁটে চলেছেন। খাড়াই-উৎরাই তাঁর কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। হেঁটে হেঁটে টাইগার হিল পর্যন্ত পাড়ি দিলেন। টাইগার হিলের কাছে দুর্গামন্দির একটি গুহার মধ্যে। সেখানেও তরতর করে নেমে গেলেন। মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে কোনও বাড়ির গৃহিণীর সঙ্গে, আবার কখনও স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলছেন। কখনও কোনও ছোট ছোট দোকানদার আবার কখনও পুলিশকর্মীদের সুবিধে-অসুবিধে জানতে চাইছেন।

এটা কলকাতায় বসে বলা সোজা যে দার্জিলিংয়ে বেড়াতে কার না ভাল লাগে। কিন্তু দু’মাস অন্তর মুখ্যমন্ত্রীর দার্জিলিং যাওয়া কাজটি কিন্তু খুব সোজা কাজ নয়। সিদ্ধার্থশঙ্কর থেকে জ্যোতিবাবু হয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য— কেউ এত বার দার্জিলিং গিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। এই যে মুখ্যমন্ত্রীর এত বার দার্জিলিং আসা, শুধুমাত্র এই আসার মাধ্যমেই সমতল ও পাহাড়ের বিভেদ-ভাবনা অনেকটা ঘুচে যায়। ঠিক যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী বারংবার জঙ্গলমহলে গিয়ে, বার বার জেলা সফরে গিয়ে বিডিওদের সঙ্গে বৈঠক করে সরাসরি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন ঠিক সে ভাবেই দার্জিলিংয়ে শিক্ষা, পর্যটন, বিভিন্ন কর্মসংস্থানের প্রকল্প— সবই তিনি সামনাসামনি নজরদারি করার সুযোগ পান।

Advertisement

এ বার রাষ্ট্রপতিও মমতার এই কাজের ধারাটি স্বচক্ষে দেখলেন। প্রণববাবু ও রাজ্যপালকে যেমন তিনি মহাকালেশ্বরের মন্দিরে নিয়ে গিয়েছেন, ঠিক সে ভাবে রাজভবনে শুধু গোর্খা নয়, লেপচা-সহ অন্য সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের ডেকে নৈশভোজ করিয়েছেন। সুভাষ ঘিসিংয়ের ছেলে থেকে গুরঙ্গ-বিরোধী অধুনা তৃণমূল নেতা হড়কাবাহাদুর ছেত্রী পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। প্রণববাবুর সৌজন্যে শুধু ইলিশ আর তাওয়া কলকাতা ভেটকি নয়, তিস্তার বোরোলি মাছের চচ্চড়ি পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছিল। প্রণববাবুর ইলিশ মাছের কাঁটা বাছতে সামান্য অসুবিধে হচ্ছিল বলে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মাছ বেছে দিতেও তৎপর ছিলেন। শুধু এখানেই শেষ নয়, মনে অতৃপ্তি ছিল বলে প্রণববাবু যখন ফিরছিলেন, তখন রাষ্ট্রপতির প্রোটোকল বিভাগের সঙ্গে ঝগড়া করে ইলিশ মাছ পাঠান মমতা। বিমানে ইলিশ মাছ নিয়ে যাওয়া নিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের আপত্তি ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর সমর্থনে এগিয়ে আসেন রাষ্ট্রপতি ব্যক্তিগত সচিব প্রদ্যুৎ গুহ। অবশেষে মমতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রণববাবু যখন দিল্লি ফিরলেন তখন সেই মাছের ঠাঁই হল রাষ্ট্রপতির বিশেষ বিমানে।

সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে মনে হল বিমল গুরুঙ্গ এখন এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। গুরুঙ্গের রাজনৈতিক উপদেষ্টা জিটিএ-র সেক্রেটারি জেনারেল স্বরাজ থাপা গুরুঙ্গের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন। বেশ অনেক ক্ষণ গুরুঙ্গের সঙ্গে কথা হল। বেশ চাপের মুখে আছেন তিনি। না পারছেন রাষ্ট্রপতি-মুখ্যমন্ত্রীকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করতে, আবার বুঝতে পারছেন গোটা পাহাড়ে আজ তিনি কার্যত কোণঠাসা। একটা সময় ছিল যখন সুভাষ ঘিসিং জিএনএলএফের মাধ্যমে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। তখন জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী। জিএনএলএফ নির্বাচন বয়কট করত। সিপিএম প্রার্থী আনন্দ পাঠক লোকসভার নির্বাচনে জিততেন। গোর্খা পার্বত্য কাউন্সিলকে কেন্দ্র-রাজ্য টাকা দিত। আর পাহাড়ের নেতা হয়ে ঘিসিং মহানন্দে দিন কাটাতেন। জ্যোতিবাবু কোনও দিন ঘিসিংকে বিব্রত করতে চাননি। বুদ্ধবাবু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে হুঙ্কার দিয়েছিলেন, কিন্তু দলের সমর্থন খুব একটা পাননি। পাহাড়ের জায়গায় পাহাড় আর সমতলের জায়গায় সমতল থেকে গিয়েছিল। কিন্তু মমতার তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু পাহাড় দখলের লক্ষ্যে এগোচ্ছে। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে পাহাড়ে তৃণমূল ভাল ভোট পেয়েছে। আলাদা জেলা গঠন, মিরিককে মহকুমা বানানোর মতো সিদ্ধান্তে গুরুঙ্গ কুপোকাৎ। গুরঙ্গবিরোধী সমস্ত দলকে মমতা একটি ছাতার তলায় নিয়ে এসেছেন। গোর্খার পাশাপাশি অন্য সমস্ত সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক বোর্ড গঠন করা হয়েছে। আবার নেপালি কবি ভানুভক্তের জন্মবার্ষিকী প্রণববাবুর সঙ্গে পালন করেছেন। দার্জিলিংয়ে পুরনির্বাচন আসন্ন। এই অবস্থায় জিটিএ-র চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় জেলা প্রশাসন। গুরুঙ্গ কেন্দ্রের দ্বারস্থ। এলাকার বিজেপি সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সাহায্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে তৎপর গুরুঙ্গ। গোর্খা সত্ত্বা আক্রান্ত, এই আওয়াজ তুলে তিনি কেন্দ্রের দ্বারস্থ হতে চান। জিটিএ চুক্তি কার্যকর হচ্ছে না বলে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক চান। কিন্তু মোদীর কাছেও গুরুঙ্গের চেয়ে ২১২টি বিধানসভা আসনে জেতা মমতার গুরুত্ব অনেক বেশি।

দিল্লি ফেরার সময়ে রাষ্ট্রপতির কনভয়ের একটি গাড়ি গভীর খাদে পড়ে যায়। সেই গাড়িটিতে মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাকর্মীও ছিলেন। সে সময়ে আমি মুখ্যমন্ত্রীর গাড়িতে ছিলাম। সামনের গাড়িতে রাজ্যপালের সঙ্গে যাচ্ছিলেন রাষ্ট্রপতি। মাঝে ছিল দু’টি এসকর্ট গাড়ি। তাদেরই একটি গাড়ি পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মমতা গাড়ি থামিয়ে খাদ থেকে ছ’জন কর্মীকে উদ্ধারের কাজে নেমে পড়েন। এই ঘটনা আপনারা টেলিভিশনে, সংবাদপত্রে পড়েছেন। শুধু একটি কথাই আমার বলা, রাজ্য পুলিশের বাঙালি কর্মীদের আমরা অনেক সময়েই ‘আন্ডার এস্টিমেট’ করি। কিন্তু সে দিন রাষ্ট্রপতি ভবনের সুঠাম শরীরের ভাল পোশাকে সজ্জিত সেনাকর্মীরা কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দড়ি ধরে খাদে নেমে পড়েননি। উল্টে বাঙালি পুলিশকর্মীরাই অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ছন্নছাড়া যুবকদের স্টাইলে হেঁই সামালো বলে যে ভাবে সহকর্মীদের বাঁচালেন সেটা কিন্তু অভাবনীয়। সাধারণত গোয়েন্দারা চান এ ধরনের ঘটনা ঘটলেই ভিভিআইপিদের সেখান থেকে সরিয়ে দিতে। কারণ ওই রকম একটি ছন্নছাড়া অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির উপরে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু মমতা মমতাই। চলে যাওয়া তো দূরের কথা, নিজে দড়ি ধরে টান দেন আহত নিরাপত্তাকর্মীদের খাদ থেকে তোলার জন্য।

এর পর গুরুঙ্গ কী করবেন সেটাই দেখার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন