অন্ধকার ঝুপ করে নামল। ঘনঘোর, অবোধ্য, মায়াময় অবুঝমাড়ের জঙ্গল যেন নেশার মতো। ছত্তীসগঢ়ে গণতন্ত্রের কুচকাওয়াজ দেখতে দেখতে পৌঁছেছিলাম অবুঝমাঢ়ে। জেলা নারায়ণপুর। এই নারায়ণপুর মাওবাদীদের দুর্ভেদ্য দুর্গ বলে পরিচিত। নারায়ণপুর শহর থেকে জঙ্গল চেরা যে রাস্তা পর্বতময় সোনপুরের দিকে গিয়েছে, সেই রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে দেখা হয়েছিল রামের সঙ্গে। রাম সর্বজ্ঞ। অবুঝমাঢ়ের গহনে লুকিয়ে থাকা গ্রাম কোকামাটার বাসিন্দা।
কথারা ডালপালা মেলে। অসুখবিসুখ হলে চিকিৎসার জন্য কোথায় যান? কোথায় আবার? প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র কত দূরে? বেশি নয়, তাঁদের গ্রাম থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার! জ্বর-সর্দি হলে সেখানে, তার বেশি কিছু হলে শহরে। অসহিষ্ণুতা ধরা পড়ে রামের গলায়। ‘‘আমরা বছরের পর বছর ভুগব কেন বলুন তো? এ রকম গ্রাম আরও অনেক আছে।’’ তা হলে ভোটে কী হবে? ‘‘অনেকে বলছেন, এ বার পরিবর্তন হবে।’’ রামের গলায় সতর্কতা।
পরিবর্তন হল। তবে, ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পিছনে কংগ্রেসের অবদান যতটা, তার থেকে ঢের বেশি বিজেপির।
গোটা দেশে কৃষক বিক্ষোভের আঁচ পাওয়া গিয়েছে বার বার। ছত্তীসগঢ়েও ২০১৭-র ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ত্রিশ মাসে প্রায় ১৩৪৪ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু বিপুল আকারে কৃষক বিক্ষোভের কথা শোনা যায়নি। সদ্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের পরিচিতিই ছিল ‘চাউলবাবা’। দু’টাকা কেজি দরে চাল বিলি করে রমন হয়ে উঠেছিলেন দরিদ্র শ্রেণির নয়নের মণি। আমলারাও তাঁকে বুঝিয়ে গিয়েছেন, সস্তায় চাল-গম পেয়ে সবাই খুশি। গোটা মন্ত্রিসভা আঁচ পাননি কৃষকের ক্ষোভের। টের পাননি, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আর রাজ্য সরকারের প্রতিশ্রুত বোনাস না পেয়ে কৃষকদের ক্ষোভ তুঙ্গে উঠেছে।
কংগ্রেস কিন্তু টের পেয়েছিল। তারা নির্বাচনী ইস্তেহার তৈরির জন্য বিজেপির কৌশলেই মাস ছয়েক আগে থেকে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। দলের প্রবীণ নেতা টি এস সিংহদেও, অম্বিকাপুরের রাজপরিবারের ছেলে ‘টি এস বাবা’ কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করতে থাকেন। ছত্তীসগঢ়ের ভারপ্রাপ্ত কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক পি এল পুনিয়াও তীব্র কৃষক অসন্তোষের কথা অনুধাবন করে রাহুল গাঁধীকে জানান। ছত্তীসগঢ়ের বিভিন্ন প্রান্তে সভা করতে গিয়ে রাহুল কৃষকের কাছে পৌঁছেছেন। জানিয়েছেন, বিজেপি কৃষক-বিরোধী, হাজার হাজার কৃষক আত্মহত্যা করলেও তাদের ঘুম ভাঙে না। এই রণকৌশল সফল হয়।
কৃষকদের এই মনোভাব কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহার তৈরিতে কাজে লাগে। প্রথমত, কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দেয়, ক্ষমতায় আসার দশ দিনের মধ্যে কৃষিঋণ মকুব করা হবে। দ্বিতীয়ত, শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কুইন্টাল পিছু ১৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫০০ টাকা করবে। তৃতীয়ত, প্রতি কুইন্টাল শস্যে তারা বোনাস দেবে ৩০০ টাকা করে, আগের দু’বছরের বকেয়া বোনাসও মিটিয়ে দেবে।
এই তিন প্রতিশ্রুতিই কৃষকদের বড় অংশের মন কেড়ে নেয়। মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের নির্বাচনী কেন্দ্র রাজনন্দগাঁওয়ে কৃষকদের মন্তব্য শুনেছি, বিজেপি সরকার কৃষকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এত বড় অসন্তোষের কথা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতে পারলেন না! দলের নিচুতলার লোকেরাও এখন বলছেন, বিজেপি আসলে অনেক দিনই রাজ্যের মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
গণসংগঠন ‘ছত্তীসগঢ় নদী ঘাঁটি মোর্চা’র আহ্বায়ক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুত্ব দিচ্ছেন আরও একটি বিষয়কে। তাঁর বক্তব্য, গত দেড়-দু’বছরে রাজ্যের বিজেপি সরকার কোনও আন্দোলনকেই মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে না দিয়ে সেগুলিকে নির্মম ভাবে দমন করা হয়েছে। যেমন, শিক্ষাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, অসংগঠিত ক্ষেত্রের দৈনিক বেতনভোগী কর্মীদের আন্দোলনকে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। এমনকী, অনশন আন্দোলনও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ফলে, সমাজের নিচুতলার বিরাট অংশ বিজেপি সরকারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছে।
বস্তুত, দীর্ঘ ছ’মাস ধরে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কংগ্রেস নেতৃত্বের আলোচনা সাধারণ মানুষকে অনুভব করাতে সমর্থ হয়েছে যে, তাঁরাও সরকারের কোনও না কোনও অংশে শামিল, নীতি নির্ধারণেরও অংশীদার। গণতান্ত্রিক পরিসরে এই অনুভব গুরুত্বপূর্ণ। জনজাতিদের ক্ষোভও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। বিজেপি সরকার রাস্তা ও বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিয়েই জনজাতি এলাকায় ‘উন্নয়ন’-এর ফিরিস্তি শুনিয়েছে।
সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা শুনিয়েছিলেন দোরনাপালের এক যুবক। মাওবাদী প্রভাবিত সুকমা জেলার কোন্টা বিধানসভা এলাকার দোরনাপালের চকে দাঁড়িয়ে এক বিকেলে নির্বাচনী হালচাল শুনছিলাম। নীরজ নামে ওই যুবক বলছিলেন, এই সরকার শিক্ষার কথা বলে। আদিবাসীদের উন্নয়নের কথা বলে। কিন্তু শিক্ষা কাকে বলে বলুন তো? এখানকার অনেক আদিবাসীকেই ডাক্তাররা টনিক লিখে দেন। প্রেসক্রিপশনে লেখা থাকে, দিনে দু’বার টনিক খেতে হবে। এমনও বহু হয়, সকালে ওষুধের দোকান থেকে টনিক কিনে নিয়ে গিয়ে বিকেলে দোকানে এসে আবার টনিক চাইছে। একবেলায় টনিক শেষ হল কী করে? দোকানের কর্মীরা অবাক হয়ে এ প্রশ্ন করায় উত্তর আসে, ডাক্তারবাবু দিনে দু’বার টনিক খেতে বলেছিলেন, তাই তিনি টনিকের গোটা ফাইল একেবারে গলায় ঢেলে দিয়েছেন। রাতের টনিক আবার কিনতে এসেছেন! নীরজের প্রশ্ন: দোষটা কি শুধুই জনজাতির? তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ভোটারেরা এ বার তাই কংগ্রেসের ভোটবাক্স ভরিয়ে দিয়েছেন। তফসিলি জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলির মধ্যে কংগ্রেস এ বারে পেয়েছে ২৪টি আসন। ১৫ বছর রাজত্ব করলেও বিজেপি কখনও এত আসন পায়নি।
সামগ্রিক ফল বলছে, এটা নিছক প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ভোট নয়। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে দিচ্ছে শাসক দলের উপর বিশ্বাস হারানোর কথাও।