দাঁড়াইয়া মুখোমুখি দুই ভাই হানে/ভ্রাতৃবক্ষ লক্ষ্য করে মৃত্যুমুখী ছুরি/ রাজ্যের মঙ্গল হবে তাহে?— রাজা গোবিন্দমাণিক্যের সেই প্রশ্ন গত কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া বারংবার পশ্চিমবঙ্গের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের দুঃস্বপ্নে হানা দিয়াছে। নাগরিক ভাবিয়াছেন, গণতন্ত্রের সর্বজনীন উৎসবে হিংস্রতার এই তাণ্ডব হইতে কি মুক্তি নাই? ৩৪ শতাংশ ‘ওয়াকওভার’, মামলার মিছিল এবং অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তার চড়াই ভাঙিয়া শেষ অবধি যখন জানা গেল, ১৪ মে পঞ্চায়েত নির্বাচন, তখন নাগরিকের মনে একটি প্রশ্নই অবশিষ্ট ছিল: অন্তত ভোটের দিনটি কি শান্তিতে কাটিবে? অতঃপর উৎসবের পূর্বাহ্ণে মুখ্যমন্ত্রী বলিলেন, ইহা গ্রামবাংলার উন্নয়নের ভোট, সকলেই যেন শান্তিতে ভোট দিয়া সেই উন্নয়নের শরিক হন। ধন্য আশা কুহকিনী— সরলপ্রাণ নাগরিক হয়তো ভাবিয়াছিলেন, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী শান্তির বাণী বিতরণ করিলেন, ভোটের দিনটি সত্যই বুঝি শান্তিতে কাটিবে, অন্ধকূপ হইতে নিস্তার মিলিবে। সোমবারের রক্তস্নাত, হিংসাবিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গ সেই বিশ্বাসের নির্বোধ অতিসারল্যের দিকে চাহিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিতেছে।
মুখ্যমন্ত্রী যখন মানুষকে ভয় না পাইতে বলিয়াছিলেন, তিনি কি স্মরণে রাখিয়াছিলেন যে, অভয়ের পরিবেশ তৈরি করিবার দায়িত্বও একক ভাবে তাঁহারই? তিনি শুধু একটি দলের মহানেত্রী নহেন, তিনি রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক। পঞ্চায়েত ভোটের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক গুরুত্ব প্রচুর। মানুষ যাহাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্বটিও তাঁহারই ছিল। তিনি ব্যর্থ হইয়াছেন। ব্যর্থ নির্বাচন কমিশনও। আদালতের প্রশ্নের উত্তরে কমিশন জানাইয়াছিল, রাজ্য সরকার নিরাপত্তার যে আয়োজন করিতেছে, তাহাতে তাহারা ‘সন্তুষ্ট’। অর্থাৎ, বিরোধীরা যত আশঙ্কাই প্রকাশ করুন, তাহারা ১৪ মে নির্বাচন করিতে প্রস্তুত। ইহাই সেই প্রস্তুতির নমুনা? এতগুলি মৃত্যু, সন্ত্রাস, ব্যালট বাক্স লুট— ইহাই তবে কমিশনের মতে আদর্শ নির্বাচন প্রক্রিয়া? এই বিপুল সন্ত্রাস কেন হইল, প্রশাসনিক ব্যর্থতার চরিত্র বুঝিতেই সেই কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। কিন্তু, তাহার পূর্বে একটি কথা বুঝিয়া লইতে হইবে। যতগুলি প্রাণহানি হইয়াছে, তাহার প্রত্যেকটির দায়িত্ব প্রশাসনের। সুদীর্ঘ কয়েক দশক যাবৎ দলদাসত্ব করিতে করিতে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ হয়তো ভুলিয়াছে, কিন্তু তাহাদের স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয় যে, গণতন্ত্রের উৎসবে যে অমূল্য প্রাণগুলি বলি হইয়াছে, তাহারা যে দলেরই হউক, তাহাদের রক্ষার সমান দায়িত্ব ছিল পুলিশেরই।
কেন রাজ্য প্রশাসন এই বিপুল সন্ত্রাস ঠেকাইতে পারিল না? অপদার্থতা? মেরুদণ্ড সোজা রাখিবার অভ্যাসের সুগভীর অভাব? না কি, ইহার পিছনে আছে হিংসার রাজনীতির গূঢ়তর এবং ভয়ালতর মন্ত্রণা? গণতন্ত্রকে নির্ভেজাল সংখ্যাগুরুতন্ত্রে পরিণত করিবার মন্ত্রণা? সেই উদ্দেশ্যে গণতন্ত্রের নামে, গণতন্ত্রের প্রকরণগুলিকে ব্যবহার করিয়া যথার্থ গণতন্ত্রকে ধ্বংস করিবার মন্ত্রণা? এই আশঙ্কাকে অহেতুক বলিয়া উড়াইয়া দিবার উপায় নাই। কারণ, প্রশাসন সন্ত্রাস রোধের সৎ চেষ্টা করিতে চাহিলে সোমবারের এই ইতিহাস রচিত হইতে পারে না। ভোটগণনার দিনটি লইয়া নাগরিকের বিশেষ কোনও আগ্রহ থাকিবার কথা নহে, কারণ এই ভোটের ফল না গুনিয়াই বলিয়া দেওয়া যায়। কিন্তু, সত্যই তিনি কী পাইলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবিয়া দেখিতে পারেন। এবং ক্ষণিকের অবকাশে রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন-এর পাতা উল্টাইয়া রাজা গোবিন্দমাণিক্যের কথাগুলি পড়িয়া লইতে পারেন, ‘‘রাজ্যে শুধু সিংহাসন আছে— গৃহস্থের ঘর নেই,/ ভাই নেই, ভ্রাতৃত্ববন্ধন নেই হেথা?’’ অবশ্য সেই রাজাই অন্যত্র, রাজর্ষি উপন্যাসে, জানাইয়া দিয়াছিলেন: হৃদয় যাহার কঠিন হইয়া গিয়াছে, দেবতার কথা সে শুনিতে পায় না।