অর্ধসত্য ভয়ঙ্কর

সত্যির মোড়কে মিথ্যে এসে প্রভাবিত করে আমাদের যুক্তিকে

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন আর জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নিয়ে ভয় পাওয়ার যে আসলে কোনও কারণ নেই, এমনকি মুসলমানদেরও না, এই কথা বুঝিয়ে একটা মেসেজ ফোনে ফোনে ঘুরছে।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০৫
Share:

নিখাদ মিথ্যে চেনা বরং তুলনায় সহজ। হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুক যে ক্ষণে ক্ষণে স্মার্টফোনের স্ক্রিন জুড়ে মিথ্যে উগরে দেয়, অন্তত ওয়াকিবহাল মহলে সেই কথাটাও এখন জানা। কাজেই, ফোনে খুচরো ভেসে আসা ‘তথ্য’-কে এখন আর নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করেন না অনেকেই। কিন্তু, চালের মধ্যে কাঁকরের মতো যেখানে অনেকটা সত্যির সঙ্গে খানিক মিথ্যের মিশেল দেওয়া থাকে? অথবা, অনেকটা মিথ্যে ঢাকা দেওয়া থাকে সত্যির হালকা আস্তরণের নীচে? সেই মিথ্যেকে চিনে নেওয়াও কি ততটাই সহজ? শুকনো পরিসংখ্যান পড়ে কি বুঝে নেওয়া যায়, কো‌থায় কতখানি মিথ্যে গুঁজে দেওয়া আছে তাতে? কোনও প্রসঙ্গকে ব্যাখ্যা করার যুক্তির মধ্যে ইচ্ছাকৃত ফাঁক রেখে দেওয়া হল কি না, এক ঝলকে বোঝা যায় কি?

Advertisement

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন আর জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নিয়ে ভয় পাওয়ার যে আসলে কোনও কারণ নেই, এমনকি মুসলমানদেরও না, এই কথা বুঝিয়ে একটা মেসেজ ফোনে ফোনে ঘুরছে। কোথাও কোনও উগ্রতা নেই, কাউকে আক্রমণ করা নেই— এমনকি, খুব জোর দিয়ে এনআরসি-সিএএ’র প্রতি পক্ষপাতও নেই। আছে আপাত-নিরীহ কিছু ‘তথ্য’— যেমন, সিএএ নাগরিকত্ব কাড়ার আইন নয়, নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন; যেমন, এই আইনের জন্য কাউকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হবে না। কথাগুলো তো সরাসরি মিথ্যে নয়। মিথ্যে রয়েছে তার ভাঁজে। সিএএ নাগরিকত্ব দেবে তিন প্রতিবেশী দেশ থেকে ধর্মীয় কারণে উদ্বাস্তু হয়ে আসা অ-মুসলমান মানুষদের। কিন্তু, যাঁরা মুসলমান? ভারতীয় মুসলমান? তাঁরা নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করবেন কোন পথে? কেন, এনআরসি। এবং, অসমের উনিশ লক্ষ মানুষের মতো যাঁরা এনআরসি-তে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবেন না? রাষ্ট্র তাঁদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাবে— এই কথাটা ভাইরাল হওয়া মেসেজের যুক্তির কোথাও বলা নেই।

যেমন, এটাও বলা নেই, হিন্দুদেরও ভয় সমান। ভারতীয় হোন বা শরণার্থী, সব অ-মুসলমানদেরও রাষ্ট্রের দরবারে লাইনে দাঁড়িয়ে জমা করতে হবে যাবতীয় কাগজপত্র। পাঁচ বছরের বেশি ভারতে শরণার্থী হয়ে আছেন, এই কথা প্রমাণ করার জন্য; অথবা তাঁরা যে ভারতেরই নাগরিক, তা প্রমাণ করার জন্য। সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে, যা অসমে বারো লক্ষ হিন্দুর নাগরিকত্ব স্বীকার করেনি। ভাইরাল মেসেজ এই কথা ভুলেও উল্লেখ করেনি। বরং বুঝিয়েছে, কোনও ভয় নেই, ‘দেশের স্বার্থে’ই সিএএ-এনআরসি প্রয়োজন। বলেছে, মেসেজটাকে যত বেশি লোকের কাছে সম্ভব, পাঠাতে— যাতে অন্যদেরও অহেতুক ভয়গুলো ভাঙে। সবার কাছে ‘তথ্য’ পৌঁছয়।

Advertisement

ঠিক যেমন, নেহরু-লিয়াকত আলি চুক্তিতে পূর্ববঙ্গের হিন্দু সংখ্যালঘুদের স্বার্থহানি হয়েছিল, এই ‘তথ্য’ সাজিয়ে ইতিহাসের পাঠসমেত যে মেসেজ ভাইরাল হল দিনকতক আগেই— সংসদে দাঁড়িয়ে অমিত শাহ এই চুক্তিতে হওয়া ‘ধোঁকা’-র কথা বলার পরে পরেই— সেই মেসেজে স্বাভাবিক ভাবেই উল্লেখ করা হয়নি, এই চুক্তি আসলে ধর্মের বেড়া টপকে পাশাপাশি থাকতে পারার মতো একটা ব্যবস্থা তৈরি করতে চেষ্টা করার কথা বলেছিল। উল্লেখ করা হয়নি, তৎকালীন হিন্দু মহাসভার নেতারা বিরোধিতা করেছিলেন এই চুক্তির, কারণ তাঁদের মত ছিল, হিন্দু আর মুসলমান মিলেমিশে থাকা সম্ভবই নয়। পাকিস্তানের উগ্রবাদীরা ঠিক এই সুরে এই কথাই বলতেন, ভাইরাল মেসেজে সেই খবর নেই। আছে শুধু চুক্তির সত্যি ইতিহাসের মধ্যে নেহরুর ব্যর্থতা সম্বন্ধে কিছু অর্ধসত্য কথা।

তার চেয়েও কম সত্য রয়েছে ‘ইতিহাস’ ব্যাখ্যা করা আর একটি মেসেজে, যেখানে দেশভাগের দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে নেহরুর ওপর। বলা হয়েছে, দেশভাগ নেহরুর পূর্ণ সম্মতি ছিল। এই কথাটা ঐতিহাসিক সত্য, সন্দেহ নেই— কিন্তু, কথাটাকে তার প্রেক্ষিত থেকে বিচ্যুত করে দেখলে মস্ত বড় ভুল হয়। পুরো সত্যটা হল, নেহরু আগাগোড়া দেশভাগের চরম বিরোধী ছিলেন। শেষ অবধি এই বিচ্ছেদের অবশ্যম্ভাবিতা দেখে তিনি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। শেষ অবধি তিনি বলেছিলেন, যদি ভাগ হতেই হয়, তবে আর দেরি না করে বরং সেটাই হোক— তা হলে অন্তত উন্নয়নের কাজগুলো শুরু করে দেওয়া যাবে। দেশভাগ যে অবশ্যম্ভাবী, এই কথাটা প্রাণপণ চেষ্টায় তাঁকে ও গাঁধীকে বুঝিয়েছিলেন কে, সেটাও জানা সমান প্রয়োজন। তাঁর নাম বল্লভভাই পটেল, নরেন্দ্র মোদী নর্মদাতীরে আকাশ ফুঁড়ে যাঁর মূর্তি স্থাপন করেছেন। ১৯৪৭-এর আগের কয়েক বছরে নেহরুর অজস্র চিঠিতে তাঁর তীব্র মানসিক যন্ত্রণার প্রমাণ ধরা আছে। ভাইরাল হওয়া মেসেজ এই কথাগুলো উল্লেখ করেনি ভুলেও। কারণ, ইতিহাসের প্রকৃত পাঠ দেওয়া সেই মেসেজের উদ্দেশ্য ছিল না। তার লক্ষ্য শুধু দেশভাগের— হিন্দুদের স্বার্থহানি করা দেশভাগের— দায় নেহরুর ওপর চাপিয়ে দেওয়া।

উদাহরণের তালিকা লম্বা করার দরকার নেই। যে কথাটা বলার, তা এটুকু থেকেই বলা যায়। নাগরিকত্ব আইন বা নাগরিক পঞ্জির খুঁটিনাটি না জানা নাগরিকের পক্ষে কি সম্ভব, এই মেসেজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মিথ্যেগুলো খুঁজে বার করা? অথবা ভারতের ইতিহাস যাঁর তন্নতন্ন করে পড়া নেই, তেমন কেউ কি ধরতে পারবেন, নেহরু সম্বন্ধে কত বড় মিথ্যে কথা অমিত শাহ সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, আর কত বড় মিথ্যে কথা ‘ইতিহাসের পাঠ’ হয়ে ভেসে এল তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে?

পারবেন না। পারার কথাও নয়। অথচ, এই বিষয়গুলো সম্বন্ধে আমি-আপনি, আমাদের মতো আম নাগরিক যে কিছুই জানি না, তা নয়। খানিকটা জানি। ভাসা ভাসা, এখানে ওখানে শোনা, সামান্য পড়া থেকে তৈরি হওয়া সেই জানা। এই মেসেজগুলো এসে পড়ে ঠিক সেই জানা-না জানার ধূসর সীমানায়। এগুলোকে ফেক নিউজ় বলে উড়িয়ে দিতে পারি না আমরা। বরং, খানিক সত্যি বলেই মনে হতে থাকে। সেই মনে হওয়াটা সম্পূর্ণ ভুলও নয়— ঠিকই তো, এই মেসেজে সত্যির ভাগ তো খানিকটা আছেই। সেই সত্যিটুকুর হাত ধরেই যাবতীয় মিথ্যে, যাবতীয় যুক্তির ফাঁক ঢুকে পড়তে থাকে আমাদের বিশ্বাসে। ‘তথ্য’ হয়ে ওঠে এই অর্ধসত্য আর ডাহা মিথ্যে।

যাঁরা একেবারে অন্ধ ভক্ত নন, যাঁদের হৃদয়ে হিন্দুরাষ্ট্রের আসন পাতা নেই, তেমন মানুষগুলো এখনও যুক্তি দিয়ে বুঝতে চান চার পাশের ঘটনাক্রম। বুঝতে চান, সিএএ নিয়ে যে তুমুল হল্লা হচ্ছে, সেটা কি আদৌ যুক্তিযুক্ত? বুঝতে চান, এই ক’দিন আগে অবধি জেএনইউ-এর ছেলেমেয়েরা হস্টেলের খরচবৃদ্ধি নিয়ে যে প্রবল আন্দোলন করছিল, সেটার মধ্যে কি ন্যায্যতা আছে? বুঝতে চান, সত্যিই কি অযোধ্যায় রামমন্দির ছিল? কিন্তু, এই কথাগুলো যুক্তি দিয়ে বোঝার জন্য যতখানি তথ্য হাতে থাকা প্রয়োজন, সেটা তাঁদের বেশির ভাগের কাছেই নেই। স্বাভাবিক ভাবেই নেই। চার পাশে প্রতি দিন যা ঘটে চলেছে, সব বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য রাখতে হলে সেটাকেই পুরো সময়ের পেশা করে নিতে হয়।

তথ্যের এই অভাবের ফাঁক গলে ঢুকে পড়তে থাকে এই বিপজ্জনক মেসেজগুলো। হাতে ধরা স্মার্টফোন অযাচিত ভাবেই জানিয়ে দেয়, জেএনইউ-তে খরচ বেড়েছে মাত্র কয়েকশো টাকা। এমন ভঙ্গিতে জানায়, যার মধ্যে কোনও বিদ্বেষ নেই, শুধু তথ্যজ্ঞাপন রয়েছে। ফলে, তাকে বিশ্বাস করতেও সুবিধা হয়। আমরা জানতে পারি না, আসলে খরচ বেড়েছে বেশ কয়েক গুণ। আমাদের অজান্তেই আমাদের মগজের দখল নেয় কিছু ভুয়ো তথ্য। আমরা জানতে পারি না এই খরচ বাড়ায় কত ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই মেসেজের যুক্তি ভুলেও আমাদের মনে করায় না যে উচ্চশিক্ষার অধিকার পকেটের পয়সার জোরের ওপর নির্ভর করে না। স্মার্টফোনের মেসেজ আমাদের মনে করতে দেয় না, ধর্মপরিচয় নির্বিশেষেই এনআরসি আমাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে পারে। হোয়াটসঅ্যাপের যুক্তি আমাদের ভুলিয়ে দেয়, জওহরলাল নেহরু ছিলেন বলেই ভারত আজ চন্দ্রযান পাঠাতে পারে।

কিছু মিথ্যে মগজে পুরে দেওয়া আর কিছু সত্যি ভুলিয়ে দেওয়া— দুটো কাজই চমৎকার করে এই মেসেজগুলো। এই ‘তথ্য’-এর জোরেই আমরা অতঃপর বুঝে নিতে থাকি চার পাশের ঘটনাক্রম। এই মিথ্যেগুলো আর সত্যের বিস্মৃতিগুলো তখন আমার-আপনার নিজস্ব যুক্তি হয়ে দাঁড়ায়। আমরা ক্রমশ বিশ্বাস করতে থাকি এই কথাগুলোকে। টেরও পাই না, হঠাৎ কখন আমরাও কথা বলতে আরম্ভ করি মোদী-শাহদের সুরে সুর বেঁধে।

ভেবে দেখলে, ভয়ঙ্কর। যাঁরা দেশব্যাপী মুসলমান-নিধনের প্রকল্পকে সমর্থন করেন না কোনও মতেই— এবং, দেশে সে রকম মানুষই এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ— তাঁরাও নাগরিকত্ব আইনের সমর্থক হয়ে ওঠেন। যাঁরা মনে করেন দেশের সব ছেলেমেয়ের লেখাপড়া শেখার অধিকার আছে, তাঁরাও বলতে থাকেন, জেএনইউ-এর ছেলেমেয়েগুলো বাড়াবাড়ি করছে। যাঁরা বাবরি মসজিদ ভাঙার বর্বরতাকে সমর্থন করেননি কখনও, তাঁরাও বলতে থাকেন— সুপ্রিম কোর্ট যখন রায় দিয়ে দিয়েছে, তখন ওই তর্ক ছেড়ে দেওয়াই ভাল। অর্থাৎ, ঠিক তথ্যগুলো ঠিক ভাবে পৌঁছে দিতে পারলে যাঁদের উদারবাদের দলে পাওয়া যেত,

কিছু আপাত-নিরীহ মেসেজ তাঁদের টেনে নেয় উগ্রবাদী পক্ষে।

পাল্টা লড়াই যদি লড়তেই হয়, তবে সবার আগে এই মানুষগুলোকে ঠিক দলে নিয়ে আসা প্রয়োজন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন