Bank

স্বার্থের সংঘাত

বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাকে ব্যাঙ্ক খুলিবার অনুমতি দিতে আপত্তি কোথায়, তাহা বোঝা যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২০ ০০:৪৪
Share:

অর্থব্যবস্থার উন্নতির জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির নাম ব্যাঙ্ক। দেশে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা যত কুশলী হইবে, শিল্পের জন্য ঋণও ততই সহজলভ্য হইবে। তাহার ফলে ব্যবসার গতি বাড়িবে, আর্থিক বৃদ্ধির পালেও সুবাতাস লাগিবে। সুতরাং, ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে নূতন পদক্ষেপ যদি সদর্থক হয়, তাহাকে স্বাগত জানানোই বিধেয়। বিশেষত ভারতের ন্যায় দেশে, যেখানে বিপুলায়তন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি অর্থনৈতিক অ-কুশলতার একশৈলিক প্রতীকের ন্যায় দাঁড়াইয়া আছে। বেশির ভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কেরই নাভিশ্বাস উঠিতেছে অনাদায়ি ঋণের দায়ে, মূলধনের অভাবে। কাজেই, ভারতকে যদি দ্রুততর বৃদ্ধির পথে হাঁটিতে হয়, তবে বেসরকারি ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের দিকে নজর দেওয়াই বিধেয়। বেসরকারি ব্যাঙ্কের লাইসেন্স ও নিয়ন্ত্রণের রূপরেখা নিরূপণের উদ্দেশ্যে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক একটি অভ্যন্তরীণ কমিটি গঠন করিয়াছিল। সম্প্রতি সেই কমিটি তাহার সুপারিশ পেশ করিল। তাহাতে বলা হইয়াছে, বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলি যদি চাহে, তবে তাহাদের ব্যাঙ্কিং লাইসেন্স দেওয়া যাইতে পারে। সিদ্ধান্তটি স্পষ্টতই ২০১৪ সালের নীতির বিপ্রতীপ। তখন বলা হইয়াছিল, বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাকে ব্যাঙ্ক খুলিবার অনুমতি না দেওয়াই বিধেয়। ব্যাঙ্কের অভ্যন্তরীণ কমিটি বর্তমান সুপারিশে বলিয়াছে, বিশ্বের মুষ্টিমেয় দেশেই এহেন নিষেধাজ্ঞা আছে। অস্যার্থ, ভারতের এই পথে হাঁটিবার প্রয়োজন নাই।

Advertisement

বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাকে ব্যাঙ্ক খুলিবার অনুমতি দিতে আপত্তি কোথায়, তাহা বোঝা যায়। একই কর্পোরেট সংস্থার বাণিজ্যিক সত্তা ও ব্যাঙ্কিং সত্তার স্বার্থ সমীপবর্তী না-ও হইতে পারে। বাণিজ্যিক সত্তা চাহিবে ব্যাঙ্কের আমানত হইতে সহজে ঋণ গ্রহণ করিতে, কিন্তু ব্যাঙ্কিং সত্তা বিচার করিবে তাহার ঋণ-গ্রহণযোগ্যতা। দুইটি সংস্থাই যদি শেষ অবধি এক মালিকানার অধীন হয়, তবে কোন সত্তার স্বার্থ রক্ষিত হইবে, সে বিষয়ে সংশয় থাকে। অর্থাৎ, ব্যাঙ্কিং মূলধন ও বাণিজ্যিক মূলধনের মধ্যে প্রয়োজনীয় দূরত্বটি বজায় না রাখিতে পারিলে স্বার্থের সংঘাত ঘটিবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। রঘুরাম রাজন ঠিক এই শঙ্কাটির কথাই প্রকাশ করিয়াছেন। এবং, এই সংঘাতে ক্ষতি দ্বিবিধ। প্রথমত, ব্যাঙ্ক যদি ঋণ-গ্রহণযোগ্যতা বিচার না করিয়াই ঋণ প্রদানে বাধ্য হয়, তবে অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ বাড়িবে— রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির প্রায়শই যে পরিণতি ঘটে। তাহাতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত, ভারতে এখনই কতিপয় কর্পোরেট সংস্থা অতি ক্ষমতাবান— দুর্জনে বলে, দেশের সর্বোচ্চ আসনটিই তাহাদের ক্ষমতার উৎস। এহেন ক্ষমতাবান কর্পোরেট সংস্থার হাতে যদি অ-বৈধ ভাবে অপরিমিত পুঁজি পৌঁছায়, তবে তাহা শিল্পক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মঙ্গল করিবে না। অর্থনীতির যে স্বার্থে অধিকতর ব্যাঙ্ক প্রয়োজন, এই ব্যবস্থা তাহারই মূলে কুঠারাঘাত করিবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কই হউক বা বেসরকারি ব্যাঙ্ক, শেষ অবধি মূল প্রশ্নটি পরিচালনার। ব্যাঙ্কের যাহা মূল কাজ— অর্থাৎ এক দিকে আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তাবিধান, আর অন্য দিকে যোগ্য ঋণপ্রার্থীকে ঋণ প্রদান করিয়া অর্থব্যবস্থায় নগদের জোগান অব্যাহত রাখা— তাহা আপসহীন ভাবে করিয়া চলিতে হইবে। রাজনৈতিক চাপ অথবা মালিকের স্বার্থরক্ষা, কোনওটিই ব্যাঙ্কের পরিচালকদের চালিকাশক্তি হইতে পারে না। কথাটি বলা যতখানি সহজ, কার্যক্ষেত্রে তাহার বাস্তবায়ন ততখানি নহে, ইহা অনস্বীকার্য। ফলে, যেখানে জটিলতা এড়ানো সম্ভব, তাহা এড়াইয়া চলাই বিধেয় নহে কি? কর্পোরেট সংস্থাকে ব্যাঙ্ক খুলিবার অনুমতি না দিলে খুব বড় কোনও ক্ষতি নাই। যেটুকু ক্ষতি, সাঙাততন্ত্রের উৎপাত হইতে ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে রক্ষা করিতে তাহা স্বীকার করিয়া লওয়াই বিধেয়।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন