সরকারি নীতি ও শিশুভবনের শিশুরা

‘ক্রেশ’ বা শিশুভবন, দেশের শিশুদের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আন্তর্জাতিক শিশু বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করেন, শিশুদের নিরাপত্তা এবং বিকাশের জন্য শিশুভবনের ভূমিকা অপরিসীম। ভারতবর্ষে ১৯৯৮ সালে জাতীয় শিশু যত্ন-নীতি সম্প্রসারিত হয় এবং শিশুদের নিরাপত্তার জন্য এক দফা কর্মসূচি গৃহীত হয়। সরকার স্থির করে, শিশুদের নিরাপত্তা ও বিকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে শিশুভবনগুলিকে নতুন করে সাজানো হবে।

Advertisement

লক্ষ্মণদাস ঠাকুরা

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:২৫
Share:

শিশুদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। নয়াদিল্লিতে। ফাইল ছবি

সম্প্রতি দেশজুড়ে পালিত হল ‘শিশু দিবস’। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জন্মদিন (১৪ নভেম্বর)-কে আমরা ‘শিশু দিবস’ নাম দিয়ে পালন করছি। বিশ্বের প্রতিটি দেশের মতো ভারতবর্ষেও শিশুদের বিকাশের জন্য সরকারের তরফে একাধিক পদক্ষেপ করা হয়েছে। তেমনই একটি পদক্ষেপ হল ‘ক্রেশ’ বা শিশুভবন, যা দেশের শিশুদের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আন্তর্জাতিক শিশু বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করেন, শিশুদের নিরাপত্তা এবং বিকাশের জন্য শিশুভবনের ভূমিকা অপরিসীম।

Advertisement

ভারতবর্ষে ১৯৯৮ সালে জাতীয় শিশু যত্ন-নীতি সম্প্রসারিত হয় এবং শিশুদের নিরাপত্তার জন্য এক দফা কর্মসূচি গৃহীত হয়। সরকার স্থির করে, শিশুদের নিরাপত্তা ও বিকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে শিশুভবনগুলিকে নতুন করে সাজানো হবে। নতুন এবং পূর্ব প্রতিষ্ঠিত শিশুভবনগুলিকে তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চয়তা দিতে হবে। ১৯৯৯ সালে সরকার শিশুদের জন্য ১৪টি আদর্শ নীতি ঘোষণা করে। এই আদর্শ নীতিগুলিতে আবার অনেক ধরনের উপনীতি ছিল। তবে সমস্ত নীতি পাঁচ রকমের যত্নগ্রহণ ব্যবস্থার উপরে প্রতিষ্ঠিত। এই যত্ন-নীতিগুলি হল—১) সারা দিনের যত্ন, ২) সাময়িক বা পার্বিক যত্ন, ৩) শিশু ভবনে থেকে যত্ন, ৪) স্কুলের বাইরের যত্ন, ৫) শিশুমনস্কদের যত্ন।

সরকার ঘোষিত ১৪টি আদর্শ নীতি উপযুক্ত ব্যক্তি, সংগঠন, যত্ন, শিক্ষা, খেলাধুলো, বাসস্থানের পরিবেশগত অবস্থান, বাসস্থানে উপযুক্ত ধরনের সরঞ্জাম, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পানীয়, সম সুযোগ প্রদান, দায়িত্বপ্রাপ্তদের ব্যবহার, পিতামাতা, ও যত্নকারীদের মধ্যে অংশীদারিত্বের কাজ, শিশু রক্ষণাবেক্ষণ, নথিপত্র সংরক্ষণ, ইত্যাদি বিষয়ের উপরে আধারিত।

Advertisement

এই নিয়মনীতিতে বলা হয়েছিল, যিনি শিশুর যত্নের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য নির্বাচিত হবেন তাঁকে নিশ্চিত করতে হবে যে তিনি কোনও শিশুকে কোনও সময় একা ছেড়ে দেবেন না। এবং এ-ও বলা হয়েছে নিযুক্ত ব্যক্তিকে শিশুদের যত্নের বিষয়ে কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে।

সংগঠনের কর্মীবৃন্দ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তাঁদের আবশ্যক ভাবে প্রতিটি শিশুর নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিশুভবনে ম্যানেজারের অবর্তমানে এক জন সহকারী ম্যানেজার থাকবেন। শিশু ও সংস্থার কর্মীর অনুপাত হবে দু’বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ১:৩, দু’বছর বয়সী শিশুদের জন্য ১:৪, তিন থেকে সাত বছর বয়সী শিশুদের জন্য ১:৮। শিশুভবনে শিশুদের যে সমস্ত দলে রাখা হবে সেখানে যেন একটি দলে ২৬ জনের বেশি শিশু না থাকে। শুধু আট বছরের কমবয়স্ক শিশুরাই শিশুভবনে থাকার অনুমতি পাবে।

খেলাধুলোর চর্চা প্রসঙ্গে নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, শিক্ষা ও খেলাধুলোর ব্যাপারে নিযুক্ত কর্মীদের বিভিন্ন বয়সের শিশুদের একত্রিত করে তাদের চাহিদা ও সামর্থ্যমতো শিক্ষা ও খেলাধুলোয় সাহায্য করতে হবে। তাদের ভুল ও ঠিকগুলি চিহ্ণিত করাতে হবে। বাসস্থানের পরিবেশ সম্পর্কে নির্দেশিকায় বলা হয়েছে যে শিশুদের থাকার জায়গাটি হবে খোলামেলা এবং সেখানে ইন্ডোর এবং আউটডোর—দু’ধরনের খেলাধুলোর জন্য উপযুক্ত জায়গা থাকতে হবে। নির্দেশিকায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে খেলাধুলোর প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের মজুত থাকার দিকেও। বলা হয়েছে শিশুভবনে শিশুদের বয়স অনুসারে উপযুক্ত খেলনা ও অন্য শিক্ষা সহায়ক উপকরণ থাকতে হবে।

নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে কোনও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিযুক্ত করা যাবে না। গ্যাস, বিদ্যুৎ, জলাশয়, নালা, ডোবা ইত্যাদির মতো ঝুঁকিপূর্ণ জায়গার কাছে শিশুদের কোনও মতেই যেতে দেওয়া হবে না। শিশুভবনে অগ্নি নির্বাপণের জন্য যথাযথ বন্দোবস্ত থাকতে হবে এবং আপৎকালীন দুর্যোগের মোকাবিলার জন্য সব রকমের পরিকঠামো তৈরি করতে হবে।

শিশুদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে কর্মীদের অভিজ্ঞতা থাকার উপরেও জোর দেওয়া হয়েছে যত্ন-নীতিতে। তারই সঙ্গে বলা হয়েছে যে শিশুভবনগুলিতে প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম সব সময়ে হাতের কাছে মজুত রাখতে হবে। খাদ্য ও পানীয় সম্পর্কে কর্মীদের সম্যক সচেতনতা তৈরির বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

শারীরিক ভাবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে যত্ন-নীতিতে। শিশুভবনের কর্মী এবং আবাসিকদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক স্থাপনের উপরেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থানীয় শিশু রক্ষণাবেক্ষণ কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার কথা বলা হয়েছে।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি জাগে তা হল শিশুভবন বা ‘ক্রেশ’ সম্পর্কে এই ১৪টি আদর্শ নীতি ঘোষিত হলেও আমাদের দেশের অধিকাংশ শিশুভবনে কি তা মানা হয়? উত্তর, নিশ্চিত ভাবেই না। কোথাও কোথাও কর্মীরা শিশুদের কোনও রকমে খাইয়েদাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ঝামেলামুক্ত হতে চান এমন শোনা যায়। অনেকে অভিযোগ করেন, অনেক শিশুভবনে শিশুদের স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হয় না। মা-বাবারা এক প্রকার বাধ্য হয়ে শিশুদের এখানে রাখতে বাধ্য হন। বহু ক্ষেত্রেই সরকার ঘোষিত আদর্শ নীতি মেনে না চললেও কোনও কার্যকরী বা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করা হয় না।

স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের দেশের অধিকাংশ শিশুভবনে সুরক্ষার প্রাথমিক ধাপগুলিও মেনে চলা হচ্ছে না। বিষয়টিকে গৌরবের বলা চলে না।

লেখক বিসিডিএস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন