Editorial News

রাজনীতিকরা সীমাজ্ঞান হারালে নাগরিকের অসম্মান হয়

বেফাঁস মন্তব্য এবং কার্যকলাপ করে তথা নিজেদের অজ্ঞানতার ফলাও বিজ্ঞাপন করে রাজনীতিকরা নিজেদেরকে সেই নেতিবাতক আলোকেই প্রতিভাত করেন। এতে নাগরিকের অসম্মান হয়।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৮ ০১:০০
Share:

জনগণের সমর্থন পাওয়া আর সর্বজ্ঞ হয়ে ওঠা এক বিষয় নয়। ভোটে জিতলে বা দায়িত্বশীল সাংবিধানিক পদে থাকলেই যে কোনও বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়ার অধিকার জন্মায়, এমনটা ভাবলে বড্ড ভুল হয়ে যায়।

Advertisement

কখনও বিপ্লব দেব, কখনও সন্তোষ গাঙ্গোয়ার, কখন রাধামোহন সিংহ, কখনও স্মৃতি ইরানি— বিশেষজ্ঞের মতো মতামত দিতে গিয়ে বা খেয়াল-খুশি অনুযায়ী মন্ত্রক চালাতে গিয়ে একের পর এক নেতা বেফাঁস মন্তব্য করছেন অথবা বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, সাংবিধানিক বন্দোবস্ত সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান বড়ই সীমিত। এই বেফাঁস কার্যকলাপ সংশ্লিষ্ট নেতা-নেত্রীদের দলের তো বটেই, সরকারের অস্বস্তিও রোজ বাড়াচ্ছে।

অস্বস্তি কতটা বেড়েছে সেটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক সতর্কবার্তা থেকেই স্পষ্ট। সংবাদমাধ্যমকে দেখলেই যাঁরা মুখ খুলে দেন, যে কোনও বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য যাঁরা উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকেন, তাঁদের সম্প্রতি সতর্ক করে দিয়েছেন মোদী। সব বিষয়ে মুখ খোলা যাবে না, যে বিষয় সম্পূর্ণ গোচরে বা আয়ত্তে নেই, তা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা যাবে না, কোনও বিষয়ে মতামত দেওয়ার আগে নিজের অধিকারের সীমাটা বুঝে নিতে হবে— মোদীর সতর্কবার্তার সারকথা মোটের উপর এই রকমই। কিন্তু বিজেপি নেতারা তথা সাংবিধানিক পদাধিকারীরা সতর্ক হয়েছেন, এমন প্রমাণ এখনও মেলেনি।

Advertisement

আসলে শুধু সতর্কবার্তা বা হুঁশিয়ারিতে কাজ হওয়ার নয়। আত্মোপলব্ধি জরুরি। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের একের পর এক সাম্প্রতিক মন্তব্যের জেরে যে হাসির রোল উঠছে, সেই হাসির রোলই বুঝিয়ে দিচ্ছে আত্মোপলব্ধি বিষয়টা আজ কতটা প্রাসঙ্গিক।

মহাভারতের যুগে ইন্টারনেটের অস্তিত্ব, সিভিল সার্ভিসে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের যোগদান তত্ত্ব, বিশ্বসুন্দরী তত্ত্ব, সরকারি চাকরির প্রতি যুবসম্প্রদায়ের আগ্রহ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মতামত— একের পর এক বিষয়ে একের পর এক বিষয়ে বেফাঁস কথা বেরিয়ে এসেছে বিপ্লব দেবের মুখ থেকে। অস্বস্তিগুলো ত্রিপুরায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, গোটা ভারতকে কৌতুক রসাস্বাদনের সুযোগ করে দিয়েছে।

এর আগে ধর্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ারের মন্তব্য, ভুয়ো খবর সংক্রান্ত সমস্যার ‘সমাধানে’ কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির অতি সক্রিয় পদক্ষেপ, কৃষকদের আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী রাধামোহন সিংহের নিজস্ব ব্যাখ্যা— একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদাধিকারীর মন্তব্য অস্বস্তিতে ফেলেছে শাসক দলকে বা সরকারকে।

তবে শুধু ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বা এই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা নন, অপ্রয়োজনীয় এবং বেফাঁস কথার স্রোতে অবদান রেখেছেন আরও অনেক মুখ্যমন্ত্রী, এমনকী প্রধানমন্ত্রীও। সেই অবদানই আমাদের ‘বুঝতে শিখিয়েছে’, সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা শুধুমাত্র সিদো-কানহো না-ও হতে পারেন, তৃতীয় কোনও নামও থাকতে পারে। সেই অবদানই আমাদের ‘বুঝতে শিখিয়েছে’ রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপিয়র ‘সমসাময়িক’ হতে পারেন, রাজা রামমোহন রায় এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার মধ্যে ‘সংযোগ’ থাকতে পারে, পেঁয়াজ ও পেঁয়াজকলির ‘পারস্পরিক সম্পর্ক’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, স্বামী বিবেকানন্দ এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে নিয়মিত ‘পত্রালাপ’ হয়ে থাকতে পারে।

অধিকার এবং বুদ্ধিবৃত্তির সীমাটা চিনে নেওয়া প্রত্যেক রাজনীতিকের পক্ষেই অত্যন্ত জরুরি। রাজনীতিকরা নাগরিকের ভোটেই নির্বাচিত হন, নাগরিকদের প্রতিনিধি হিসেবেই রাষ্ট্রচালনায় অংশ নেন। নাগরিক কিন্তু নিজের প্রতিনিধিকে নেতিবাচক আলোকে দেখতে পছন্দ করেন না। বেফাঁস মন্তব্য এবং কার্যকলাপ করে তথা নিজেদের অজ্ঞানতার ফলাও বিজ্ঞাপন করে রাজনীতিকরা নিজেদেরকে সেই নেতিবাতক আলোকেই প্রতিভাত করেন। এতে নাগরিকের অসম্মান হয়। আমার ভোটে নির্বাচিত হয়ে যিনি রাষ্ট্রচালনায় অংশ নিচ্ছেন, তিনি এত কম জানেন? তিনি এত অসংবেদনশীল? এই প্রশ্ন উঠতেই সঙ্কোচ বোধ করেন নাগরিক, অস্বস্তিতে পড়ে যান। রাজনীতিকদের আত্মোপলব্ধি নাগরিককে সেই সঙ্কোচ, অস্বস্তি এবং তজ্জনিত অসম্মান থেকে রক্ষা করতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন