ঝাড়খণ্ডে জয় হল লোকবুদ্ধির

খরিদ্দারি ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে, সবাই জানে। পার্টিগুলোর মধ্যে ধোয়া তুলসীপাতাও বিরল। তবু, ক্রয়-ক্ষমতার সঙ্গে ক্রয়-কৌশলের মিশেল ঘটানোর দক্ষতায় বিজেপি ফার্স্ট বয় বলে নাম কিনেছে, অন্যরা তার ধারেকাছে নেই।

Advertisement

কুমার রাণা

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০০
Share:

আরে ভাই, অসলি বাত থ্যয়লা, বাকি সব ম্যয়লা।” ঝাড়খণ্ড বিধানসভার ফল বেরোবার দু’দিন আগেও এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন দুমকা জেলার এক সাধারণ বিজেপি কার্যকর্তা। ভোটে জিততে টাকা মুখ্য, বাকি সব গৌণ— বিজেপির বুনিয়াদি স্তরের কর্মীরাও এমন একটা ধারণা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন পার্টির (আজসু পার্টি) সঙ্গে জোট না হওয়ায় বিজেপির ক্ষতির সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি: “গঠবন্ধন উঠবন্ধন, সব উড় যায়েগা, দো-চারঠো জো কম পড়েগা, খরিদ লেঙ্গে।”

Advertisement

খরিদ্দারি ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে, সবাই জানে। পার্টিগুলোর মধ্যে ধোয়া তুলসীপাতাও বিরল। তবু, ক্রয়-ক্ষমতার সঙ্গে ক্রয়-কৌশলের মিশেল ঘটানোর দক্ষতায় বিজেপি ফার্স্ট বয় বলে নাম কিনেছে, অন্যরা তার ধারেকাছে নেই। জনপ্রতিনিধি কিনে নেওয়ার অহঙ্কারী প্রত্যয়ের পিছনে এই অভিজ্ঞতাই বাস্তব রসদ। এবং, কে না জানে, বিশ্বাস ও আত্মজে ফারাক নেই— বিশ্বাসকে লোকে সন্তানের মতো লালন করতে সুখ পান। অতএব, এ-বছর মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচন ভিন্ন কথা বললেও বিজেপি কার্যকর্তারা সেটাকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা ভাবতে পারেননি।

ভাবতে না পারলেই দেশের মঙ্গল। দর্পীর অহঙ্কার যত বলবান হয়, লোকবুদ্ধি ততই সক্রিয় হয়, তা সে ১৯৭৫-৭৭ কালপর্বের জরুরি অবস্থার ঘটনা হোক বা চলমান সময়ে ভারতের অন্তরাত্মাকে হত্যা করার একের পর এক উদ্যোগই হোক। সমাজের সুস্থতাকামী লোকেদের জন্য আশার কথা— ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচন এই লোকবুদ্ধির সক্রিয়তাকে আরও এক বার প্রমাণ করল। লোকেরা এমন ভাবে ভোট দিলেন যাতে বিজেপি টাকার থলে বার করার সুযোগই না পায়। ভোটের হাটে যাঁরা নিজেদের চড়া দামে বিক্রির কথা ভেবে পুলকিত হচ্ছিলেন, নির্বাচকরা তাঁদের সামনে থেকে সেই সুযোগটা আগেভাগেই কেড়ে নিয়ে তুলনামূলক ভাবে জটিলতাহীন অ-বিজেপি সরকার গড়ার রায় দিলেন।

Advertisement

ওপরের কথাগুলোতে উচ্ছ্বাস স্পষ্ট। কিন্তু, যে অবস্থায় এই নির্বাচন হল, তাতে উচ্ছ্বসিত না হতে পারা কঠিন। বিজেপির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ঝাড়খণ্ড মুক্তিমোর্চা (জেএমএম)-কংগ্রেস জোটটাকে নড়বড়ে বললে কম বলা হবে। গোটা কংগ্রেস দলের সংগঠন ঠিক ভোটের আগেই ধাক্কা খেয়েছে। গত পাঁচ বছরের বিজেপি শাসনে জেএমএম নেতৃত্বও এমন কোনও আন্দোলন সংগঠিত করেননি, যা দিয়ে তাঁরা এক প্রকৃত লোকহিতৈষী চরিত্র তুলে ধরতে পারেন। আলাদা ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের দাবির পিছনে বিভিন্ন যুক্তির মধ্যে অন্যতম দিক ছিল মূলবাসীদের অধিকার সুরক্ষিত করা। ঔপনিবেশিক শাসনের সময় থেকে এক দিকে বাইরে থেকে এসে বসত গড়া এবং অন্য দিকে ভূমিপুত্র ও ভূমিকন্যাদের উৎখাত হওয়ার ধারা স্বাধীনতা-পরবর্তী কালেও অব্যাহত। ১৮৯১ থেকে ১৯৫০ কালপর্বে এখানে বাইরের লোকের আগমন বেড়েছে চোদ্দো গুণ। অন্য দিকে, আদিবাসীদের নির্গমন ঘটেছে বিপুল মাত্রায়, লক্ষ লক্ষ লোক ভিটেমাটি ছেড়ে অসম-উত্তরবঙ্গের চা-বাগানে মজুর হিসেবে বসত গড়তে বাধ্য হয়েছেন, এমনকি তফসিলভুক্ত হওয়ার সুযোগও তাঁদের জোটেনি। অ-আদিবাসী বহিরাগমন ও আদিবাসী দেশান্তরের ভারসাম্যহীনতার কারণে ১৯৫০ সালেও যেখানে ঝাড়খণ্ডে লোকসংখ্যায় আদিবাসীরা ছিলেন ৩৬ শতাংশ, সেটা আজ কমে দাঁড়িয়েছে ২৬ শতাংশ। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে বিজেপি এখানে প্রথম অ-আদিবাসী মুখ্যমন্ত্রী বসায়। সাঁওতাল পরগনা টেনান্সি অ্যাক্ট এবং ছোটনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার যে সীমিত সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিল, বিজেপি সরকার সেগুলোকে খর্ব করার উপক্রম করে। আদিবাসীদের যেটুকু জমি অবশিষ্ট আছে, প্রলুব্ধ কর্পোরেট নজর সেটুকুও কেড়ে নিতে আগ্রাসী হয়, সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে।

এর সঙ্গে নেমে আসে মানুষের ওপর নানা অত্যাচার। খাদ্য-সুরক্ষা, একশো দিনের কাজ, ইত্যাদি সামাজিক প্রকল্পকে আধারের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। লোকে অনাহারে মারা যান। অথচ, এগুলো নিয়ে আন্দোলনের কারণে জঁ দ্রেজ়-এর মতো সমাজশাস্ত্রী গ্রেফতার হলেও বিরোধী দলগুলো, বিশেষত জেএমএম, তেমন বড় আকারে আন্দোলনে নামেনি। গত ডিসেম্বরেও দুমকার গ্রামগুলোতে মুখর অভিযোগ শোনা গিয়েছে গুরুজি শিবু সোরেন ও তাঁর পুত্রের সক্রিয়তার অভাব নিয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন