ইনস্টিটিউটের সবচেয়ে উঁচু বাড়িটার তলায় ধপ করে দেহটা আছড়ে পড়ার আগের মুহূর্ত অবধি কেউ জানতেই পারেননি কতটা মানসিক অবসাদে ভুগছিল ছাত্রটি। নতুন বিয়ে-হওয়া ছাত্রীটির গলায় দড়ি দেওয়ার বেলায় তো অন্তত তাঁর ডায়েরিটা সাক্ষী হয়েছিল; ছেলেটার সমস্যার কথা কলেজের বন্ধুরা নয়, শিক্ষকরা নন, এমনকী মা-বাবাও ঘুণাক্ষরেও টের পাননি।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সাবালক হিসেবে কলেজে ঢুকে অল্পবিস্তর সমস্যার সম্মুখীন প্রায় সকলেই হন। শুরুর দিকে হয়তো আমরা তা গায়ে মাখি না; কিন্তু গোড়ার সামান্য সমস্যাই ধীরে ধীরে বৃহদাকার ধারণ করতে পারে। পরিণামে আত্মহননের পথ যে বেছে নিতে হবে তা মোটেই নয়; তবু, কখনও কখনও মনে হয়, সমাধানের আর যেন কোনও পথ খোলা নেই।
আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিজেদের ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা সমাধানের জন্য কোনও পথ বা নীতি তৈরির কথা ভাবেই না। আগের লেখায় (‘ছাত্রকল্যাণ: ওরা আর আমরা’, ২৯-৭) ছাত্রছাত্রীদের যৌথ সমস্যার কথা লিখেছিলাম; এই লেখার বিষয় ব্যক্তিগত সমস্যা। কোন কোন সমস্যাকে ব্যক্তিগত বলব, সে সংজ্ঞা অবশ্যই আপেক্ষিক। তবে এটা মানতেই হবে, আমাদের সমাজ ‘ব্যক্তিগত’ কথাটার অর্থ প্রায়শই বেমালুম ভুলে যায়; ব্যক্তিকে ও তাঁর সমস্যাকে সম্মান জানাতেই কোনও ব্যক্তিগত কথা যে পাঁচকান করতে নেই তা আমাদের মাথায় থাকে না, প্রাইভেটকে পাবলিক করে তুলে আমরা সমস্যা দশগুণ বাড়িয়ে তুলি।
সমাজই এ-রকম হলে ক্যাম্পাস কেমন হবে তা সহজে আন্দাজ করা যায়। আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিশেষ করে সদ্য-সাবালক-হওয়া প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা তো দূর, তাঁদের পরামর্শ দেওয়ার বা নিদেনপক্ষে তাঁদের কথা মন দিয়ে শোনার মতো কেউ থাকেন না; কোনও জায়গা নেই, যেখানে মনের কথা বলা যায়। অন্যের সমস্যার কথা জানতে পেরে তা নিয়ে কলেজ চত্বরে মুখরোচক আলোচনা না করলে যেন ঠিক বিকেলের চা-টা জমে না। সমস্যা যত প্রকট হয়, চর্চাও তত বাড়ে; তখন সত্যি ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খোলা থাকে না!
কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যক্তিগত সমস্যাগুলোকে অ্যাকাডেমিক বা শিক্ষা সংক্রান্ত ও নন-অ্যাকাডেমিক, এই দু’ভাগে ভাগ করা যায়। তবে, ‘বাংলা মাধ্যম স্কুল থেকে কলেজে এসে ইংরাজিতে লেকচার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে’ অথবা ‘ফুটবল খেলতে গিয়ে পা মচকে এক সপ্তাহ কলেজ কামাই করতে হবে’ জাতীয় কিছু শিক্ষাগত সমস্যা বাদ দিলে ব্যক্তিগত সমস্যার সিংহভাগই বোধ করি নন-অ্যাকাডেমিক। তাই, সংবেদনশীলতা, সহানুভূতির সঙ্গে এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন মর্যাদাবোধ।
ব্যক্তিগত এই নন-অ্যাকাডেমিক সমস্যাগুলোর পিছনে অনেকাংশেই পারিবারিক পরিবেশ ও অর্থনৈতিক অবস্থার বড় ভূমিকা থাকে। কলকাতার কলেজে পড়তে অনেকেই রোজ যাতায়াত করেন শহরতলি থেকে; কেউ কেউ আবার দূরের জেলার কোনও গ্রাম থেকে প্রথম বার কলকাতায় এসে থাকছেন। এই যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার সমস্যাগুলোও ভিন্ন ভিন্ন ধরনের— কেউ দক্ষিণের মেট্রোতে পনেরো মিনিটে কলেজে আসেন, কারও পাক্কা তিন ঘণ্টা ধকল সইতে হয়; কারও ছাত্রাবাসে সকালে চানের জল মেলে না, তো কারও সাতসকালে লোকাল ধরতে ভাত খাওয়া হয় না। আবার কিছু সমস্যা ধনী-দরিদ্র বা শহরতলি-গ্রামকে মিশিয়ে দেয়— যৌন-হেনস্তা থেকে শুরু করে সোশ্যাল-মিডিয়া-ঘটিত সমস্যা, সাইবার-বুলিইং যে কোনও ছাত্রছাত্রীর জীবনেই ঘটতে পারে।
তবে, সমস্যা অ্যাকাডেমিক হোক বা নন-অ্যাকাডেমিক, ছাত্রজীবনে কোপটা কিন্তু পড়াশোনার উপরই এসে পড়ে— লেকচারে না যাওয়া থেকে ক্রমে অ্যাসাইনমেন্ট জমা না দেওয়া, পরীক্ষায় অনুপস্থিতি, শেষটায় ডিগ্রি না পাওয়া।
ক্ষতিটা যেহেতু শিক্ষাগত, অতএব দায়িত্বটাও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁধে নিতে হবে বইকি; সব শিক্ষক-অধ্যাপকও এই দায়ভার ভাগ করতে পারেন। প্রশ্ন হল, কী ভাবে? ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা সমাধানের আগে শিক্ষকদের, অভিভাবকদের, কলেজ-কর্তৃপক্ষকে ছাত্রছাত্রীদের বুঝতে হবে, তাঁদের কথা শুনতে হবে। দুঃখজনক হল, এই বোঝা বা শোনার লোকেরই বড় অভাব, কেউ কেউ থাকলেও তাঁদের সময়ের অভাব। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে কোনও নীতি বা কাঠামো নেই। যতটুকু হয়তো কয়েক দশক আগেও ছিল, ইউনিয়নের দাপটে তা এখন রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
এই ক্ষেত্রে বিলেতের পদ্ধতিটা বেশ কাজের। বিলেতের বিভাগীয় স্তরে সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য থাকেন এক জন ‘টিউটর’। কাজটা সবাই ভাগ করে নেন; ধরা যাক, অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক স্তরে তিন বছরে মোট ৬০০ জন ছাত্রছাত্রী আছেন, অধ্যাপকের সংখ্যা ৩০, মানে প্রতি ২০ জনের জন্য এক জন টিউটর, যিনি এই ২০ জন ছাত্রছাত্রীর সব সমস্যা মন দিয়ে শুনবেন এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে সমধান হিসেবে যা যা ব্যবস্থা করা যায় তা করবেন। অনেক ছাত্রছাত্রী কথাই বলতে চান না, খোলসের মধ্যে গুমরে থাকেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় নীতি অনুযায়ী প্রতি তিন মাস অন্তর টিউটরের সঙ্গে দেখা করতেই হবে, কথা বলতেই হবে।
শিক্ষকরা মনোবিজ্ঞানী নন, অতএব তাঁদের কাজ মনোবিদের দায়িত্ব পালন নয়, অনেকাংশেই কাজটা হল ‘সাউন্ডিং বোর্ড’ হয়ে শ্রোতার ভূমিকা পালন। শর্ত হল, সম্মতি ছাড়া কারও সমস্যা চর্চা তো দূর, কাউকে বলাও চলবে না। এটুকু তো আমাদের দেশি ব্যবস্থাতেও করা যেতেই পারে। তবে, টিউটরকে বলেই তো সমস্যার সমাধান হয় না; কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বিস্তর নীতি ও পরিকাঠামো প্রয়োজন, আর সেখানেই আমরা অনেক অনেক পিছিয়ে।
ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক