Woman revolutionary

স্বাধীনতা সংগ্রামে রাঙামাটির অগ্নিকন্যারা

হয়তো সবার নাম এই স্বল্প পরিসরে এল না, কিন্তু ভারতের স্বদেশি আন্দোলন ও স্বাধীনতার জন্য বীরভূমের অসংখ্য মহিলা বিপ্লবীর অবদান রয়েছে। হয়তো একটা গোটা সংবাদপত্রেও সেই নামগুলো ছাপানো হলে জায়গা কম পড়বে। তাঁদেরই কয়েকজনের অবদানকে মনে করালেন বিতান ভট্টাচার্যহয়তো সবার নাম এই স্বল্প পরিসরে এল না, কিন্তু ভারতের স্বদেশি আন্দোলন ও স্বাধীনতার জন্য বীরভূমের অসংখ্য মহিলা বিপ্লবীর অবদান রয়েছে। হয়তো একটা গোটা সংবাদপত্রেও সেই নামগুলো ছাপানো হলে জায়গা কম পড়বে। তাঁদেরই কয়েকজনের অবদানকে মনে করালেন বিতান ভট্টাচার্য

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২০ ০৭:৪৭
Share:

দুকড়িবালা চক্রবর্তী ও সত্যবালা চট্টোপাধ্যায়।

আজ স্বাধীনতা দিবস। নাম জানা, অজানা অসংখ্য সাহসী প্রাণের আত্মবলিদানের স্বীকৃতির দিন। স্বাধীনতা সংগ্রাম আর সংগ্রামীদের সঙ্গে ১৫ অগস্ট দিনটা শুধু মুক্তির আনন্দ নয় অন্যরকম এক অনুভূতিও মনকে স্পর্শ করে।

Advertisement

পরাধীন ভারত, তাকে স্বাধীন করতে হবে এটুকুই হয়তো আপ্তবাক্যের মতো ছিল বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর কাছে। কারও প্রথাগত শিক্ষা নেই, কেউ অতি সাধারণ গৃহবধূ। সংসারের বাইরে কোনও জগতও নেই। কোন অনুভূতি থেকে তাঁদের আত্মবলিদান? সবাই যে অকালে মৃত্যু বরণ করেছেন এমনটাও নয়, কষ্ট সহ্য করেছেন, সংসার, পরিবার ছেড়ে জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে বছরের পর বছর কেটেছে এ সংখ্যাটাও কম নয়। বীরভূম কার্যতই বীর ভূমি। বীরাঙ্গনাদের ভূমি।

যদি কবিগুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার থেকেই দেখা যায়, তাঁর ভাগ্নী স্বর্ণকুমারীদেবীর মেয়ে সরলাবালা দেবী চৌধুরাণী ১৯০৩ সাল থেকে ‘বীরাষ্টমী’ ব্রত পালন চালু করলেন। লাঠি ও ছুরি খেলা, খাদির প্রচার আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রতিষ্ঠা করলেন। বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান জনসভাগুলিতে গেয়ে জাতীয়তাবোধ উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করলেন।

Advertisement

১৯৪২ এর অসহযোগ আন্দোলনে বোলপুরে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা রানি চন্দের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মাতঙ্গিনী হাজরার মাটির মেয়ে ছিলেন রানি। ১৯১১ সালে মেদিনীপুরে তাঁর জন্ম। শান্তিনিকেতনের কলাভবনে পড়তে আসা। সেই থেকে বীরভূমকে আঁকড়ে ছিলেন। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল রাঢ়বঙ্গের মাটিতে। পাঁচ মাস কারাদণ্ডও হয়েছিল তাঁর সেই সময়। কারাবাসের সময়ের ছবি চিত্রায়িত হয়েছে তাঁর ‘জেনানা ফটক’ বইটিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্রী নন্দিতা কৃপালনী, শান্তিনিকেতনের ছাত্রী এলা দত্ত, ভবানী সেন, শান্তি দাসগুপ্তা, মমতা রাও, প্রভাসিনী চক্রবর্তীদের মতো অনেকেই অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। ১৯৪২ সালে বোলপুরে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর ঘটনা স্বাধীনতা সংগ্রামকে অনেকটা সংগঠিত করেছিল। প্রতিবাদে দুবরাজপুর মুনসেফ আদালত ভাঙচুর হয়। বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হন অনেকেই। অসহযোগ আন্দোলনে ৩০ অগস্ট রানি চন্দ-সহ নন্দিতা কৃপালনী, মমতা রাওরা গ্রেফতার হন।

লাল মাটিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা এলে সন্ধ্যারানি সিংহের নাম আসবে স্বাভাবিক ভাবেই। বীরভূমের জাজিগ্রামে ১৯২৮ সালে সপরিবারে আসেন। স্বামী লালবিহারী সিংহের অনুপ্রেরণায় কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৪১ সালে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। স্বাধীনতার যোদ্ধাদের থাকা, খাওয়া সবকিছু দেখভাল করতেন সন্ধ্যারানি। অবশ্য এই কাজটা তখন করতেন না এমন মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামী মেলা ভার। অহল্যাদেবী, মায়া ঘোষ, সাবিত্রী গাঁধী কতজনের অবদান রয়েছে ১৯৪২ এর আন্দোলনে। মণিপ্রভা মুখোপাধ্যায়, ঊষা মাহারা, নীহারিকা মজুমদার, লাবণ্যপ্রভা মুখোপাধ্যায়দের মতো শিক্ষিকারাও ১৯৪২ এর আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন, মেয়েদের আত্মনির্ভর হওয়ায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। জেলে গিয়েও আন্দোলন জারি রাখায় পিছপা হননি সাবিত্রী গাঁধী, সন্ধ্যারানি সিংহরা।

মল্লারপুরের মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন সত্যবালা চট্টোপাধ্যায়। ১৯৩০ এর আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাঁর। ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতার শপথ বাক্য পাঠ হবে সিউড়িতে। সবার আগে তেরঙা পতাকা হাতে চলেছেন তিনি। মল্লারপুর থেকে ২২ মাইল পথ পায়ে হেঁটে। বন্দে মাতরম ধ্বনি উঠছে সেই মিছিল থেকে। সিউড়ি সার্কিট হাউজের সামনে পুলিশ বাধা দিল। নিগৃহীত হলেও পতাকা ছাড়েননি সত্যবালাদেবী। কৃষক আন্দোলন থেকে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গড়ে তোলা সবেতেই তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। আমৃত্যু দেশের জন্য কাজ করা এই মহিয়সী স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনসন নিতে চাননি। ‘‘মা’কে পরাধীন করে রেখেছিল যারা তাদের কাছ থেকে মা’কে স্বাধীন করার জন্য টাকা নেব সন্তান হয়ে!’’ এই প্রশ্নটাই বুঝিয়ে দেয় এমন সত্যবালাদের মর্মস্পর্শী অবদানকে।

বোলপুরের আরেক স্বাধীনতা সংগ্রামী পঙ্কজিনী রায়। গাঁধীজির সঙ্গে ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। সবরমতি আশ্রমেও গিয়েছিলেন। মহিলা সংগঠন গড়ায় তাঁর অবদান অপরিসীম। বোলপুর পুরসভার তিনিই প্রথম মহিলা কমিশনার ছিলেন। রাজগ্রামের আমোদিনী দাস, বোলপুরের স্মৃতিকণা বসু, ময়ূরেশ্বরের অলোকা পাল, পাইকরের গুরুভাবিনী দেবী, দুবরাজপুরের সরোজিনী নায়েক, আমোদপুরের সিন্ধুবালা দত্ত, ভালাসের সাবিত্রী গুপ্তা, হরিভাবিনী গুপ্তা, বীণাপানি ঘোষ সাঁইথিয়ার গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় কত শত নাম। জোতদারের গোলা লুট করে মন্বন্তরে না খেতে পাওয়া মানুষগুলোকে খাইয়েছিলেন গীতাদেবীদের মতো সংগ্রামীরা। দাঙ্গা পীড়িতদের সেবা করেছেন। বিপ্লবীদের আশ্রয় দিয়েছেন।

হয়তো এই স্বল্প পরিসরে সব নাম, সবার আত্মত্যাগ স্পষ্ট হল না, তবে দু’জনের কথা না বললেই নয়। বাংলার বিপ্লবীরা দেশ মা’কে স্বাধীন করতে গিয়ে ঘরের মায়েদের সাহায্য নিয়েছেন বারবার। কখনও মাসিমা, কখনও পিসিমা ডাকে তাঁরা সর্বজনীন হয়েছেন।

বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেজ পিসিমা ননীবালাদেবী ‘যুগান্তর’ বিপ্লবী দলে ‘মেজ পিসিমা’ নামে সুপরিচিত ছিলেন। আর একজন যিনি সবার মাসিমা তাঁর কথা দিয়ে বীরভূমের অগ্নিকন্যাদের এই সামান্য পরিচিতির অংশটুকু শেষ করব।

১৯১৪ সালের এই অগস্টেই রডা কোম্পানির ৫০টি মাউজার পিস্তল এবং ১২০০০ কার্তুজ বিপ্লবীরা সুকৌশলে সরিয়ে নেন। মাঝে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও ১৯১৭ সালের ৮ জানুয়ারি পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে ৭টি পিস্তল ও ১২০০ মতো কার্তুজ বাজেয়াপ্ত করে দুকড়িবালা চক্রবর্তীর শ্বশুরবাড়ি নলহাটি থানার ঝাউপাড়া থেকে। দুকড়িবালাদেবীর বাপের বাড়িও ছিল ওই ঝাউপাড়া গ্রামেই। অবশ্য তল্লাশির খবর পেয়ে তিনি পিস্তল ও কার্তুজ সুরধনী মোল্লানির বাড়িতে সরিয়ে দেন। পুলিশ সে খবরও পেয়ে যায় এবং সেগুলি আটক করে। দুকড়িবালার বোনপো নিবারণ ঘটক এই পিস্তল ও কার্তুজ রাখতে দিয়েছিলেন তাঁকে। নিবারণ মাসিমা ডাকতেন বলে দুকড়িবালাও স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে সর্বজনীন মাসিমা হয়ে গিয়েছিলেন। নিবারণ হুগলি মহসীন কলেজে পড়তেন। সেখানে তিনি ‘যুগান্তর’ দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বহু সময় বহু বিপ্লবী ঠাঁই নিয়েছেন এই মাসিমার কাছে। এই ঘটনার পরে দুকড়িবালা ও নিবারণের নামে পুলিশ মামলা রুজু করে। সিউড়িতে স্পেশ্যাল ট্রাইবুনালে মামলার বিচার হয় এবং ওই বছরই ৯ মার্চ মামলার রায় বেরোয়। দুকড়িবালাকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। নিবারণের পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। স্বাধীনতার লড়াইয়ে দুকড়িবালাই ছিলেন অস্ত্র আইনে ধৃত প্রথম মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামী।

তথ্যঋণ- বীরভূমের মুখ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন