ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
এ বার বিষ্ণুর কী হবে? হিন্দুত্ববাদীরা বাল্মীকি রামায়ণে ‘উত্তরকাণ্ড’র যাবতীয় বিকৃতি সংশোধনের জন্য আগামী মাসেই গোরক্ষপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার ডাকতে চলেছেন। প্রয়োজনে এক ডজনেরও বেশি সংশোধনের জন্য মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের দ্বারস্থ হবেন তাঁরা। তাঁদের প্রধান যুক্তি হল, উত্তরকাণ্ড ‘আদি রামায়ণ’-এ নেই, তা প্রক্ষিপ্ত। সুতরাং বর্জনীয়।
উত্তরকাণ্ড যে প্রক্ষিপ্ত, সেটা নতুন কোনও তথ্য নয়। পণ্ডিত এবং গবেষকরা অনেকেই একমত, রামায়ণে বালকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড দুটোই প্রক্ষিপ্ত। অযোধ্যাকাণ্ড, সুন্দরকাণ্ড, যুদ্ধকাণ্ড ইত্যাদিতে যা নেই, তেমন অনেক কিছুই রয়ে গিয়েছে উত্তরকাণ্ডে। যেমন, এই দুই কাণ্ডে রামকে বারংবার ভগবান হিসেবে দেখানো হয়েছে। অগস্ত্য এবং অন্যান্য ঋষিরা বারংবার রামচন্দ্রকে তাঁর প্রকৃত স্বরূপ মনে পড়িয়ে দিচ্ছেন, ‘হে রাম, তুমিই সেই জনার্দন হরি, রাক্ষসবধের জন্য মর্তে অবতীর্ণ হয়েছ।’ সেখানেই শেষ নয়। সরযূ নদীতে আত্মবিসর্জনে যাচ্ছেন রাম। স্বাগত জানালেন পিতামহ ব্রহ্মা, ‘বিষ্ণু, এ বার স্বর্গে এস। তুমি কালপরিচ্ছেদের অনায়ত্ত, অমর।’ প্রক্ষিপ্ত, নিশ্চয়ই। প্রাচীনতর রামায়ণে এ সব ছিল না। কিন্তু এই কারণে মহাকাব্যের অঙ্গচ্ছেদ করে তাকে ‘শুদ্ধ’ করে নেওয়ার প্রস্তাব কেউ দেয়নি, দেওয়ার কথা ভাবেওনি। রামচন্দ্রের ইমেজ বাঁচাতে বিষ্ণুকেই কেটে উড়িয়ে দেব— সংঘ পরিবার ছাড়া কার মাথাতেই বা আসতে পারে?
রাম যদি সত্যিই বিষ্ণু হন, লক্ষ্মীরূপিণী সীতা কেন নির্বাসনে যাবেন? মধ্যযুগের ভক্তিবাদও প্রশ্নটা নিয়ে ভেবেছে। তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’-এ তাই ছায়াসীতা। রাবণ জঙ্গলে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে সীতা তাঁর ছায়ামূর্তি রেখে অদৃশ্য হন। রাবণ সেই ছায়ামূর্তি অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যান। কম্বনের তামিল রামায়ণে আবার বনবাসের আগে রামচন্দ্র সীতাকে অগ্নিদেবের কাছে সুরক্ষিত রেখে গিয়েছিলেন। যুদ্ধের শেষে সেই অগ্নিদেবের কাছেই সতীত্বের পরীক্ষা। উত্তরকাণ্ডের কিঞ্চিৎ অদলবদল করে গত সাত-আটশো বছর ধরে এই ভাবে হিন্দি, তামিল ইত্যাদি ভাষায় বহু রামায়ণী ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে। এটাই ভারতবর্ষের বহুত্ববাদ।
রামায়ণে নানা কাহিনি থেকেই নানা প্রশ্ন ওঠে, উত্তরকাণ্ডে তাদের কোনও কোনওটির উত্তর মেলে। এক নয়, একাধিক উত্তর। এই বহুত্বের একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। রাবণের মতো রাক্ষস একাকিনী সীতাকে অশোকবনে ফেলে রাখল, ধর্ষণ-টর্ষণ করতে গেল না কেন? উত্তরকাণ্ডে এর একাধিক উত্তর আছে। যেমন, এক দিন হিমালয়ের অরণ্যে ঘুরতে ঘুরতে রাবণ এক সুন্দরী মেয়েকে দেখে। মাথায় জটা, তপস্যায় মগ্ন। মহিলা বললেন, তিনি রাজর্ষি কুশধ্বজের মেয়ে। বেদের মধ্য দিয়ে বাঙ্ময়ী মূর্তিতে তাঁর জন্ম, তাই তাঁর নাম বেদবতী। বিষ্ণুকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য তপস্যা করছেন। কামার্ত রাবণ তখন অস্থির, ‘কে বিষ্ণু? ধুর!’ বলেই বেদবতীর চুল টানে। বেদবতী সঙ্গে সঙ্গে চুল কেটে ফেলে নিজের মৃত্যুর জন্য চিতা সাজালেন, ‘পাপিষ্ঠ, তোর বিনাশের জন্য ফের কোনও ধার্মিকের অযোনিজা কন্যা হিসাবে জন্মাব।’
এ বার অন্য গল্প বলি। চাঁদনি রাতে রাবণ কৈলাস পর্বতে তার রাক্ষস সৈন্যদের নিয়ে বসে আছে, পথ বেয়ে চলেছে অপ্সরা রম্ভা। রাবণ বলল, ‘আহা সুন্দরি, ওই স্তনযুগল আজ কে স্পর্শ করবে? কে পান করবে তোমার অধরামৃত?’ অপ্সরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জানাল, সে রাবণের পুত্রবধূসম। রাবণের ভাই কুবের, তারই ছেলে নলকুবের। তিনিই রম্ভার স্বামী। রাবণ অট্টহাসি হেসে উঠল, ‘অপ্সরার আবার স্বামী!’ অতঃপর ধর্ষিতা রম্ভা ছাড়া পেয়ে নলকুবেরের কাছে গিয়ে আছড়ে পড়ে। নলকুবের তখনই অভিশাপ দিলেন, ‘এর পর রাবণ কামার্ত হয়ে যখনই কোনও অনিচ্ছুক মেয়ের উপর বলপ্রয়োগ করতে যাবে, ওর দশ মাথা একশো টুকরো হয়ে যাবে।’ মহাকাব্য মানে একটা প্রশ্নের একটাই উত্তর নয়।
আর একটা প্রশ্ন ওঠে সুন্দরকাণ্ডে। হনুমানকে বেঁধে রাবণের সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। স্ফটিক সিংহাসনে সোনার মুকুট মাথায় রাবণ। হনুমান মুগ্ধ, কী অসাধারণ রূপ! রাক্ষস দেখে এই মুগ্ধতা কেন? উত্তরকাণ্ড জানাবে, দশানন আসলে বিশ্রবা মুনির ছেলে। বিষ্ণুর হাতে পরাস্ত রাক্ষসেরা তখন রসাতলে লুকিয়ে। সে সময় সুমালী রাক্ষস তার মেয়ে কৈকসীকে বলল, ‘তুমি প্রজাপতি ব্রহ্মার বংশোদ্ভুত ওই ঋষিকে প্রার্থনা কর।’ রাবণ, বিভীষণ, শূর্পনখা, কুম্ভকর্ণ এই দম্পতিরই ছেলেমেয়ে। রাবণ এর পর দশ হাজার বছর ধরে ব্রহ্মার বর পেতে তপস্যা করে। প্রতি হাজার বছর অন্তর একটা করে মাথা কেটে যজ্ঞে আহুতি দেয়। রাক্ষস মানে আজন্ম ভিলেন নয়। তপস্যা করে, তাদের মেয়েরা মুনিঋষিদের বিয়েও করে। এগুলি সম্পাদনা করলে রামায়ণ আর মহাকাব্য থাকবে না।
আর একটা প্রশ্ন। যে হনুমান এত বড় মহাবীর, এক লাফে সাগর ডিঙিয়ে যান, বালী-সুগ্রীব দ্বৈরথে তিনি নিশ্চেষ্ট ছিলেন কেন? উত্তরকাণ্ড জানাচ্ছে, শিশু বয়সে পবনপুত্র ঋষিদের আশ্রমে ঢুকে খুব অত্যাচার করতেন। কারও যজ্ঞভাণ্ড উলটে দিতেন, কারও বা বল্কল ছিঁড়ে দিতেন। ঋষিরা শাপ দিলেন, ‘যে বল আশ্রয় করে এত দৌরাত্ম্য করছ, সেটা তুমি বহুকাল ভুলে থাকবে। কেউ মনে করিয়ে দিলে তখন ফের শক্তিমান হবে।’ মনে পড়ছে, সুন্দরকাণ্ডে জাম্ববানই হনুমানকে তাঁর জন্মকথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন? তার পরই সাগরপাড়ি।
কিংবা ধরা যাক সীতার বনবাসের গল্পটাই। প্রমোদবনে গর্ভিণী সীতা স্বামীর কাছে আবদার ধরেছেন, তিনি এক রাতের জন্য তপোবনে যাবেন, ফলমূল খেয়ে থাকবেন। তার পর রাম রাজসভায় গিয়ে বসলে সংবাদদাতা জানায়, রাজ্যের সর্বত্র রামের জয়গান। আরও পীড়াপীড়িতে জানায়, ‘লোকে বলছে, পরপুরুষের ঘরে থাকা সত্ত্বেও রাম মৈথিলিকে কী ভাবে ঘরে তুললেন? প্রজারা রাজাকে অনুকরণ করে। ফলে, এ বার আমাদের বউরা অন্যের ঘরে চলে গেলেও পরে তাদের ঠাঁই দিতে হবে।’ এ বার প্রজারাও তবে রামকে দশরথের মতো কামুক বলে গাল দেবে? এখানেই মহাকবি ঢুকে পড়লেন মঞ্চে, তপোবনে রোরুদ্যমান সীতাকে দেখে বললেন, ‘‘তুমি নিষ্পাপ, আমি জানি।’’ আরএসএস-এর কোপে এমন দৃশ্যও বাদ পড়বে?
আসলে হিন্দুত্ববাদীরা ইউরোপের হাতফেরতা ‘র্যাশনাল’ দৃষ্টিভঙ্গিতেই সব প্রশ্নের উত্তর চাইছেন। রাম দেবতা কি না? সীতাবর্জন উচিত না অনুচিত? যেন একটি প্রশ্নের একটাই উত্তর। তবে এ ব্যাপারে কেবল তাঁদের দোষ দিলে ভুল হবে। সেকুলার এবং নারীবাদীরাও প্রায়শই সেই পথে হাঁটেন। একমাত্রিক খণ্ডদৃষ্টিতে দেখে রামচন্দ্রকে শভিনিস্ট, ব্রাহ্মণ্যবাদী বলে গাল পাড়েন। প্রথমে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। মেনে নিতে হবে, ভারতীয় ঐতিহ্যে একটা প্রশ্নের বহু উত্তর, বহু ব্যাখ্যা থাকাই স্বাভাবিক!
শম্বুক বধের ক্ষেত্রে যেমন! এক ব্রাহ্মণ রাজসভায় তাঁর মরা ছেলেকে এনে উপস্থিত, রামরাজ্যে নিশ্চয় কোথাও পাপ হচ্ছে। দেখা গেল, শম্বুক নামে এক শূদ্র তপস্যারত, রাম খড়্গাঘাতে তার মাথা কেটে দিলেন। চণ্ডালরাজ গুহকের বন্ধু ব্রাহ্মণ্যবাদী! ফিরে চলুন মহাকাব্যের আদিপর্বে। দশরথের তিরে অন্ধমুনির ছেলে মারা যায়। মৃত্যুর আগে সে আত্মপরিচয় দেয়, ‘আমার বাবা বৈশ্য, মা শূদ্রাণী।’ মানে, এঁদের তপশ্চর্যায় নিষেধ নেই।
কিন্তু শম্বুক বধের একটু আগে নারদ এসে রামকে উসকে সর্বব্যাপী অবক্ষয়ের কথা জানালেন। সত্যযুগে কেবল ব্রাহ্মণরাই তপস্যা করতেন। ত্রেতায় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় দুই জনেই। দ্বাপরে বৈশ্যরাও করত, এখন কলিকালে শূদ্ররাও! অধর্মের পাল্লা তাই ক্রমশ ভারী হচ্ছে। ঋষিদের তপস্যার পুণ্যফলের এক-ষষ্ঠাংশ পান রাজা, ফলে কোথায় নিয়মভঙ্গ ঘটছে, দেখা তাঁর দায়িত্ব। রামকে অহেতুক রণবীর সেনা বানিয়ে লাভ নেই। শম্বুকবধেরও হরেক উত্তর আছে।
উত্তরকাণ্ড ছেঁটে দিলে এ সব আর থাকবে না। রয়ে যাবে শুধু রাম-রাবণের যুদ্ধ, সীতার পাতিব্রত্য মার্কা একটি আবদ্ধ কাঠামো। আজকের হিন্দুত্ববাদ সেটাই চায়। রামায়ণ চুলোয় যাক।